“মোদি সরকারের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। কিন্তু মুসলমানদের অধিকাংশই ভীষণ হতাশ” বললেন তসলিমা নাসরিন

বাংলাহান্ট ডেস্ক: বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিন। বাংলাদেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে বর্তমানে ভারতের বাসিন্দা। ভারতের বিভিন্ন ঘটনায় তিনি তার মত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করে থাকেন। বর্তমানে গোটা বিশ্ব উত্তাল ভারত কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে। ভারত কাশ্মীর ইস্যুতে ভিন্ন ধর্ম ভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। গতকাল নিজের সোশ্যাল মিডিয়ায় তসলিমা নাসরিন একটি লেখা পোস্ট করেন। সেখানেই তিনি ভারত কাশ্মীর ইস্যু নিয়ে নিজের মতামত প্রকাশ করেছেন। দেখে নিন কি বললেন তিনি। তসলিমা নাসরিনের লেখায় হুবহু তুলে ধরা হলো নিচে।

   

“এই লেখাটা হাল্কা, তবে ততটা নয়।

কাশ্মীরে বেড়াতে গিয়েছিলাম ‘৮৮ সালে। নাকি ’৮৯ সালে? ’৮৯ সালে হলেও মনে হয় শুরুর দিকে। ‘৮৯র শেষ দিকে তো ভায়োলেন্স শুরু হয়ে গেছে। ডাল লেকের হাউজবোটে ছিলাম কয়েকটি দিন। বোটের ভেতরে লেকের পচা পানির গন্ধ আসতো। বোটের বাথরুমে স্নান করতে হতো লেকের ওই পচা পানিতেই। শামীম নামে একটা ছেলে কাজ করতো হাউজবোটে। ওকে দিয়ে খাবার পানি আনাতাম ঘরে। তখন শীতকাল। শীত থেকে বাঁচার জন্য শামীম তার পরণের আলখাল্লার আড়ালে একটা হাতলওয়ালা মাটির পাত্র রাখতো, ওই পাত্রে থাকতো জ্বলন্ত কয়লা। মাটির পাত্রটিকে কাশ্মীরি ভাষায় কাংগির বলে। কাংগির হাতে নিয়েই হাঁটাচলা করতো শামীম। আমার ভয় হতো শামীমের গায়ে কখন না আগুন ধরে যায়। কাংগির একটু অসাবধানে হেলে পড়লেই তো দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। শামীমকে বখশিস দিলে খুব খুশি হতো। আমাকে বেশ কয়েক বার বলেছে আমাকে তোমার দেশে নিয়ে চলো। শামীমের মতো যুবকদের কাশ্মীরে আরও দেখেছি, দারিদ্র তাদের সর্বাংগে। কাশ্মীরের প্রকৃতিকেই শুধু সুন্দর দেখেছি, অধিকাংশ বাড়ি ঘরে, দোকানপাটে, রাস্তাঘাটে মলিনতা, ধুসরতা, বিবর্ণতা। শালিমার বাগান তখন মরে রয়েছে। মানুষের মুখ চোখে হতাশা। শিকারায় চড়েছি। সুন্দরী সুন্দরী মেয়ে চারদিকে। কিন্তু হাসি নেই আরও মুখে। অশান্তি উড়ে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়।

কাশ্মীরে কত ধর্মের, কত বর্ণের , কত জাতের, কত দেশ দেশান্তরের লোক যে এসেছে, বসত করেছে, তার শেষ নেই। শুনেছি জম্মু থেকে কাশ্মীরের একটি সেতুর নামই নাকি গ্রীক সম্রাট আলেকজান্দারের ঘোড়ার নামে, বুসাফেলাস। সম্রাট অশোক এসেছেন, সংগে বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে এসেছেন । বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার কাশ্মীর থেকে লাদাঘ, লাদাঘ থেকে চীনে পৌঁচেছে। পঞ্চম শতাব্দীর আগে কাশ্মীর হয়ে উঠেছিল হিন্দু ধর্ম আর বৌদ্ধ ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈববাদের উত্থান ঘটে। শিবের ভক্তে ছেয়ে যায় কাশ্মীর, দূর দূরান্তেও ছড়িয়ে পড়ে এই শৈববাদ। ত্রয়োদশ থেকে পঞ্চদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলাম বিস্তার করে। কিন্তু তাতে অতীতের ধর্মগুলো হারিয়ে যায় নি, বরং নতুন ইসলামি সংস্কৃতির সংগে মিলে মিশে এক হয়েছে। অনেকে বলে কাশ্মীরিয়ানা অথবা কাশ্মীরি সুফিবাদের জন্ম এভাবেই।

দীর্ঘকাল কাশ্মীর শাসন করেছে মুসলমান শাসকেরা। প্রথমে শাসন করেছে সুলতান, সুলতানকে সরিয়ে মুঘল এলো কাশ্মীর শাসন করতে, মুঘলকে সরিয়ে আফগান দুররানি এলো, তারপর শিখরা দখল করে নেয় কাশ্মীর। ইংরেজের সংগে শিখরা যুদ্ধে পরাজিত হলে ইংরেজের কাছ থেকে জম্মুর রাজা গুলাব সিং কিনে নেন কাশ্মীর। কাশ্মীর উপত্যকার ওপর লোভ সবার ছিল। বৃহত্তর কাশ্মীরের এক টুকরো এখন ভারতের (৪৫%), আরেক টুকরো পাকিস্তানের (৩৫%), বাকি টুকরো চীনের(২০%)। কাশ্মীর নিয়ে কামড়াকামড়ি সেই যে শুরু হয়েছে আজও শেষ হয়নি।

সর্ব ধর্মের মিলনস্থল কাশ্মীর হলেও, কাশ্মীরি মুসলমানেরা ১৯৯০ সালে শত শত কাশ্মীরি হিন্দুদের (পণ্ডিতদের) খুন করেছে, লক্ষ লক্ষকে তাড়িয়ে দিয়েছে কাশ্মীরি উপত্যকা থেকে। মুসলমানরা একা থাকবে কাশ্মীরে। কাশ্মীর কি মুসলমানদের একার কখনও ছিল? কাশ্মীরের অমরনাথে হিন্দুদের তীর্থযাত্রা বন্ধ হয়ে গেল এ বছর। কাশ্মীরের সরকার জানালো তীর্থযাত্রীদের ওপর সন্ত্রাসীরা হামলা করতে পারে। তারপরই শুনি ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা তুলে নিয়েছে ভারত সরকার।

দেশভাগের পর থেকে ভারত অধিকৃত কাশ্মীর যে আলাদা মর্যাদা পেত ভারতের কাছ থেকে, সেটি তুলে নিয়েছে ভারত। কাশ্মীরের নিজস্ব পতাকা, আলাদা সংবিধান, স্বায়ত্বশাসন ইত্যাদি সুবিধে সব তুলে নিয়েছে। সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি বাতিল করেছে। কাশ্মীরি ছাড়া বাইরের কেউ কাশ্মীরে জায়গা জমি কিনতে পারবে না, কাশ্মীরে কোনও অকাশ্মীরি চাকরিও করতে পারবে না, এই নিয়মগুলো সব এখন বাতিল। ৩৭০ ধারাটি সাময়িক ছিল, এই সাময়িক ধারাটিই টিকতে টিকতে ৭০ বছরের বেশি টিকেছে। ভারতের কথা, তোমার প্রতিরক্ষা, তোমার নিরাপত্তা, তোমার যোগাযোগ, তোমার বিদেশ মন্ত্রণালয় ইত্যাদির দেখভাল করবো, কিন্তু কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতাবাদ আর সন্ত্রাসবাদের চাষ হতে থাকবে! তা কেন হতে দেব? কাশ্মীরকে রক্ষা করতে ভারতীয় সেনারা প্রাণ দিতে থাকবে, কিন্তু ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে পাকিস্তানের পতাকা উড়বে! পাকিস্তান থেকে সন্ত্রাসীরা আসতেই থাকবে উপত্যকার যুবসমাজকে ভারতবিদ্বেষ দিয়ে মগজধোলাই করে করে সন্ত্রাসী বানাতে। দিল্লির পার্লামেন্ট পর্যন্ত হামলা করতে চলে আসতে পারে, এমনই আত্মঘাতি সন্ত্রাসী ! এসব আর কতকাল সইবো?এখন তো পাকিস্তান থেকে আর সন্ত্রাসীদের আসতে হয় না ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস চালানোর জন্য। এখন সন্ত্রাসী কাশ্মীরেই জন্মাচ্ছে। পুলওয়ামারের সন্ত্রাসী তো ভারত অধিকৃত কাশ্মীরেরই ছিল, যে আত্মঘাতি বোমা হয়ে ৪০ জন ভারতীয় জওয়ানকেও হত্যা করেছে। ৩৭০ ধারাটি উঠে যাওয়ার পর ভারতীয়রা এখন তীর্থ যাত্রায় বাধার সম্মুখীন হবে না, কাশ্মীরে জমি জায়গা কিনতে চাইলে কিনতে পারবে। কাশ্মীরী হিন্দুরা নিজেদের বাড়িঘরে ফেরত যেতে পারবে। সন্ত্রাস বন্ধ হলে উন্নয়ন হবে, কাশ্মীরের যেটির সবচেয়ে বেশি দরকার । বেকারত্ব ঘোচাতে হবে। শিক্ষা স্বাস্থ্য সচ্ছলতা সচেতনতা স্বাধীনতা সবারই অধিকার। কাশ্মীরিরা কেন বঞ্চিত হবে এ থেকে!

ভারতীয় হিন্দুরা ভীষণ খুশি। এত খুশি যে মোদি সরকারের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। কিন্তু মুসলমানদের অধিকাংশই ভীষণ হতাশ। তাদের দুশ্চিন্তা, কাশ্মীরে এখন ধনী হিন্দুরা ঢুকবে আর অবাধে জমি জমা কিনবে। কাশ্মীর আর কাশ্মীরিদের থাকবে না। কাশ্মীরে যে রেফারেন্ডাম হওয়ার কথা ছিল, আজও হয়নি, সেটি যদি একদিন হয়, হয়তো ভারত থেকে কাশ্মীরকে বিচ্ছিন্ন করার পক্ষে ভোট আর পড়বে না, কারণ সেদিন হয়তো কাশ্মীরে মুসলমানের চেয়ে হিন্দুই হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। উত্তর- আয়ারল্যান্ডের মতো। ওখানে আইরিশের চেয়ে ইংলিশ আর স্কটিশের সংখ্যাই বেশি। আইরিশদের ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ওরাই একসময় দলে দলে গিয়ে উত্তর-আয়ারল্যান্ডে স্থায়ীবাস শুরু করেছিল। সে কারণেই আর কখনও গোটা আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হবে না। রেফারেন্ডামে ব্রিটেনের পক্ষেই উত্তর-আয়ারল্যান্ডের ইংলিশ আর স্কটিশরা ভোট দেয়।

কাশ্মীর যে একাই ভারতের বিশেষ মর্যাদা পেত তা নয়। ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের আরও কিছু রাজ্য এই মর্যাদা পেত, এখনো পায়। নাগাল্যান্ডের বাইরের কেউ চাইলেই নাগাল্যাণ্ডে জমি কিনতে পারবে না। কেন নাগাল্যাণ্ড এবং এমন অন্যান্য রাজ্যের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা হচ্ছে না, কিন্তু কাশ্মীরেরটা হচ্ছে, এই প্রশ্নটি উঠছে। ধীরে ধীরে নিশ্চয়ই সব রাজ্য থেকেই বিশেষ ব্যাপারটি সরিয়ে নেওয়া হবে। কাশ্মীরে যেমন মিলিটারির ভয়ে তটস্থ থাকে মানুষ, উত্তর-পূর্ব অঞ্চলগুলোতেই তাই। মিলিটারির অত্যাচারের খবর মাঝে মধ্যেই পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। একবার মনিপুরের বয়স্ক মহিলারা সম্পূর্ণ উলংগ হয়ে মিলিটারি ক্যাম্পের সামনে বিশাল ব্যানার হাতে দাঁড়িয়েছিল , ব্যানারে লেখা ছিল, এসো, আমাদের ধর্ষণ করো। ধর্ষণের বিরুদ্ধে এমন বলিষ্ঠ প্রতিবাদ আমি আর দেখিনি আগে।

ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারাটি বাতিল করার পর গণতন্ত্রের পক্ষে যাঁরা সংগ্রাম করছেন, তাঁরা ভীষণ ক্ষুব্ধ। কাশ্মীরের নেতাদের গৃহবন্দি করে রাখা, ইন্টারনেট ফোন ইত্যাদি যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া, কার্ফু চালু রাখা, স্কুল কলেজ, অফিস আদালত, রাস্তা ঘাট, বাজার হাট সব বন্ধ করে দেওয়া, লক্ষ লক্ষ মিলিটারি দিয়ে কাশ্মীর ভরে ফেলা, ঘরে ঘরে গিয়ে কাশ্মীরি যুবকদের ধরে নিয়ে যাওয়া –বহু বছর ধরে তো কাশ্মীরি যুবকদের নিয়েছে মিলিটারি, বহু যুবকের হদিস আর পাওয়া যায়নি- এভাবে কি কেউ কোনও নিয়ম পরিবর্তন করে? গণতান্ত্রিক পদ্ধতি না মেনে জোর জবরদস্তি করে ভালো নিয়ম আনবে অন্যের জন্য? না, এভাবে পরিবর্তনটি আনার দরকার ছিল না। কাশ্মীরির নেতাদের সংগে কথা বলে, ৩৭০ ধারাটি বাতিল করার প্রয়োজনীয়তার পক্ষে ওঁদের বলে বুঝিয়ে ওঁরা রাজি হলে যদি ৩৭০ ধারা উঠিয়ে নেওয়া হতো, তাহলে চমৎকার হতো। কেউ কেউ বলে কাশ্মীরি এক একজন নেতা কাশ্মীরকে বেচে খাচ্ছিলেন, প্রাচুর্যে ডুবে ছিলেন ওঁরা, ওঁরা কোনওদিন কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাকে বাতিল করতে দিতে চাইতেনই না।

৩৭০ ধারাটি বাতিল করায় কাশ্মীরি পণ্ডিতরা এখন বিষম আনন্দ করছেন, সব কাশ্মীরি পণ্ডিত খুশি, তা নয় কিন্তু। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের একটি অংশ জানিয়েছেন, উপত্যকার মানুষের সংগে আলোচনা না করে কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে একতরফা জম্মু ও কাশ্মীরের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে, তা অত্যন্ত আপত্তিকর। এই নিন্দেয় সুর মিলিয়েছেন কাশ্মীরের ডোগরা এবং শিখ অধিবাসীদের একটি অংশ।

আলোচনা করে নিলে হয়তো কোনওদিনই সম্ভব ছিল না ৩৭০ নামের এই সাময়িক ধারাটি বাতিল করা। ক্রীতদাস প্রথা বাতিল করার সময় জনগণের সমর্থন খুবই কম ছিল। ভারতবর্ষে সতিদাহ বন্ধ হয়েছে, বিধবা বিবাহ চালু হয়েছে, কোনওটই মানুষের সমর্থন নিয়ে নয়। কিছু কিছু ভালো কাজ করে ফেলতে হয়, মূর্খ অন্ধ মানবাধিকারবিরোধী নারীবিরোধী মৌলবাদিরা বাধা দিলেও। কিছুদিন আগে তিন তালাক বাতিল হলো ভারতে। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি মুসলিম দেশে তিন তালাকের আইন নিষিদ্ধ। কিন্তু মুসলিমদের ভোট নিলে কিন্তু অধিকাংশই তিন তালাকের পক্ষেই বলতো। বড় বড় শিক্ষিত মুসলিম নেতারাই তো তিন তালাক বাতিল চাননি। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি কোনও মুসলমানই চান না। তাহলে কি সমানাধিকারের ভিত্তিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি ভারতে আসবে না? মুসলমান মেয়েরা ধর্মীয় আইনের কারণে সমান উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হতেই থাকবে? মুসলমান পুরুষেরা বহুবিবাহ করতেই থাকবে? সন্তানের ওপর মায়ের চেয়ে বেশি বাবার অধিকারই বহাল থাকবে?

কাশ্মীরে নতুন নিয়মটি আসায় কাশ্মীরের কী কী ক্ষতি হলো? অকাশ্মীরীরাও কাশ্মিরীদের কাছ থেকে জমি কিনতে পারবে, এ ছাড়া আর কী আপত্তিকর? আপত্তিরই বা কী আছে। কাশ্মীরিদের কেন কাশ্মীরেই বাস করতে হবে? ভারতের যে কোনও অঞ্চলে কাশ্মীরিরা বাস করছে না? করছে। ভারতের যে কোনও স্কুলে কলেজে কাশ্মীরিদের পড়ার অধিকার আছে, যে কোনও অফিসে চাকরি করার অধিকার আছে, যে কোনও জায়গায় ব্যবসা করার অধিকার আছে। তাহলে চিড়িয়াখানার মতো কাশ্মীরেই কেন কাশ্মীরিদের পড়ে থাকতে হবে? ৩৭০ বাতিল করার আগে কাশ্মীর কী এমন স্বর্গ ছিল, কী এমন সুখ শান্তি ছিল যে হঠাৎ নষ্ট হয়ে গেল সব? মেয়েদের কতটুকু অধিকার ছিল? মেয়েদের গানের দলকে ফতোয়া দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হলো, জাইরা ওয়াসিমের মতো জনপ্রিয় অভিনেত্রী অভিনয় ছাড়তে বাধ্য হলো। মানুষ যারা কাশ্মীরের জন্য কাঁদছে, তারা কেন কাঁদছে? দীর্ঘকাল যাবত ভারতীয় সেনা আর আর কাশ্মীরের যুবকদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে, গুলি আর ইটপাটকেলের অসম যুদ্ধ। গুম হচ্ছে, খুন হচ্ছে, রক্তপাতের শেষ ছিল না। এই অবস্থার তো বদল জরুরি।

ভারত অধিকৃত কাশ্মীরের কেউ কেউ ভারতের অংশ হতে চায়, কেউ পাকিস্তানের সংগে মিশে যেতে চায়, কেউ আলাদা কাশ্মীর রাজ্য চায়। এই তিন ইচ্ছের একটি ইচ্ছেকে মূল্য দিতে গেলেই গোল বাঁধবে। আর পাকিস্তানের সংগে ভারত কেন তার কাশ্মীরকে যেতে দেবে! পাকিস্তান অধিকৃত আজাদ কাশ্মীর তো আছেই, যেখানে পাকিস্তানি সেনারা ভারত বিরোধী সন্ত্রাসের ঘাঁটি বানিয়ে রেখেছে। কাশ্মীরের এই একাংশ কোথায় যেত? কী খেত? তার চেয়ে এই ভালো। কাশ্মীরের স্থানীয় সরকারের বদলে আপাতত কাশ্মীরের দায়িত্ব ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নিল। এটিই শেষ কথা নয়। সুপ্রীম কোর্ট রাজি না হলে ৩৭০ ধারা রদ করা যাবে না।

একবার ভারত ভাগ করেই সন্ত্রাসী প্রতিবেশির জন্ম দিয়েছে ভারত। আর কত সীমানায় গড়ে উঠতে দেবে সন্ত্রাসের আঁতুড়ঘর! সম্ভবত কাশ্মীর বেরিয়ে গেলে সীমান্তের আরও আরও রাজ্য, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। একটা বড় দেশকে টিকিয়ে রাখতে হলে যা করতে হয় ভারত তাই করার চেষ্টা করছে। ১৯৪৭ সালের ভুলটি এই দেশ আর করতে চায় না। ১৯৪৭-এর টুকরো টুকরো গ্যাং লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যুই এনেছে, ঘৃণা আর সংঘাতই এনেছে, ধর্ম বর্ণের উর্ধে গিয়ে পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ সৃষ্টি করতে পারেনি।

পাকিস্তান কিন্তু ক্ষেপে উঠেছে। ‘মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই’- এর রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। কাশ্মীর পাকিস্তানের, পাকিস্তানের মানুষ মনে প্রাণে তা-ই বিশ্বাস করতে শিখেছে। ভারত অধিকৃত কাশ্মীরকে অগণতান্ত্রিক ভাবে লুফে নিয়ে এখন আজাদ কাশ্মীরের দিকে হাত বাড়াবে ভারত – পাকিস্তান অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে। এ সময় ভারতের বিরুদ্ধে আস্ফালন না করলে প্রধান মন্ত্রী ইমরান খান নিজের জনপ্রিয়তা খোয়াবেন। যতই আস্ফালন তিনি করুন, কে তাঁর পাশে দাঁড়াবে এক চীন ছাড়া? অর্থনৈতিক আর রাজনৈতিক স্বার্থ ছাড়া কে কার বনের মোষ তাড়াতে যায় ? মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো কিন্তু ভারতের সংগে যতটা আছে, পাকিস্তানের সংগে ততটা নেই।

ভারত পাকিস্তানে ঝগড়া হলে বড় ভয় হয় আমার। হাতে ওদের পারমাণবিক বোমা। ট্রিগার টিপ্লেই হলো। মরে সব ছাই হয়ে যাবে। শুধু কি ওরাই মরবে, গোটা পৃথিবীর মানুষ মরবে।

কাশ্মীরে কিছু একটা দুর্ঘটনা ঘটলে আমার খুব শামীমের কথা মনে পড়ে। শামীম কেমন আছে? বেঁচে আছে তো? নাকি ওকে মিলিটারিরা কোনও একদিন তুলে নিয়ে গেছে, আর ও ফেরত আসেনি ? বেঁচে যদি থাকে, তাহলে সেও কি মিলিটারির দিকে ইটপাটকেল ছোঁড়ে? শামীম কি সন্ত্রাসী দলে যোগ দিয়েছে? হিজবুল মুজাহিদীন দলের ২১ বছর বয়সী কমান্ডার বুরহান ওয়ানিকে ভারতের মিলিটারিরা মেরে ফেলার পর কাশ্মীরী যুবকদের সন্ত্রাসী হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। যেমন সন্ত্রাসী বাড়ছে, তেমন ঘরে ঘরে ঢুকে মিলিটারিদের তল্লাশি বাড়ছে। যেমন সন্ত্রাসী বাড়ছে, তেমন গুম খুন বাড়ছে। শামীম কি আর সব শান্তশিষ্ট কাশ্মীরির মতো চাকরি বাকরি করে ঘর সংসার করছে? বুকের ভেতর আগুনটা লুকিয়ে রেখেছে, যে আগুন কোনও পাত্রে ধরে না?

আশা করছি কাশ্মীর নিয়ে ভারত পাকিস্তানের লড়াই ঝগড়া বন্ধ হবে। দুই দেশে বন্ধুত্ব হবে। কাশ্মীর থেকে অনিশ্চয়তা, অনিরাপত্তা, দারিদ্র,দুর্যোগ দূর হবে। কাশ্মীরের মেয়েদের মুখে হাসি ফুটবে, কাশ্মীরের পুরুষেরা আনন্দ করবে। মিলিটারিরা ওদের অত্যাচার করবে না। ওরাও সন্ত্রাস করবে না। মানুষই পারে শান্তি আনতে। আবার এই মানুষই পারে অশান্তি আনতে। অশান্তিটা পলিটিক্সের অংশ। শান্তি কবে পলিটিক্সের অংশ হবে?”

সম্পর্কিত খবর