“রানু ভালো গান গান। কিন্তু যদি লতার মতো গাইতে না পারেন এখন …” বললেন তসলিমা নাসরিন

বাংলাহান্ট ডেস্ক: মাত্র কয়েকদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় হঠাৎ করে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। তাতে দেখা যায় স্টেশন চত্বরে বসে গান গাইছেন এক মহিলা। তার কন্ঠে ‘এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়’ শুনে অবাক সবাই। কণ্ঠ শুনে মনে হয়েছে লতা মুংগেশকারের ছায়া রয়েছে তার মধ্যে। রানু মন্ডল কে নিয়ে কথা বলেছেন সবাই বাদশার নেই বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিন। ফেসবুকে একটি পোস্ট লিখে তিনি এ মন্তব্য করলেন রানু মন্ডল কে নিয়ে। দেখুন কি লিখলেন তিনি।

“রানু মণ্ডলের কাহিনী অনেকটা সুজান বয়েলের মতো।২০০৮ সালে ব্রিটেন গট ট্যালেন্ট শোতে এসেছিলেন সুজান বয়েল। দেখতে মোটেও ভালো নয়, শরীর ভর্তি চর্বি, পেটে ভূঁড়ি, চূড়ান্ত গেঁয়ো, চুলের কোনও স্টাইল নেই, কাপড় চোপড় যাচ্ছেতাই, বয়স প্রায় পঞ্চাশের কাছে, কথার কোনও ছিরি নেই। এমন মহিলা মঞ্চে কী আর পরিবেশন করবেন! সিমোন কাঊল তো রীতিমত অবজ্ঞার হাসি হাসছেন, যখন সুজান বললেন তিনি গান গাইবেন। সুজানকে ক্লাউনের মতোই মনে হচ্ছিল। দর্শকরাও মোটে আশা করছিল না সুজানের কাছ থেকে ভালো কিছু, বিচারকরা তো ননই। কারো এক্সপেক্টেশান ছিল না এক ফোঁটা। কিন্তু সুজান যখন গেয়ে উঠলেন আই ড্রিমড এ ড্রিম । মানুষ স্তব্ধ হয়ে গেল। গানটি শেষ হলে মানুষ ফেটে পড়লো উচ্ছাসে। সবাই, এমনকী সিমোনও সুজানকে স্ট্যান্ডিং ওভেশান দিলেন। সারা বিশ্বে তৎক্ষণাৎ বিখ্যাত হয়ে উঠলেন সুজান। তাঁকে নিয়ে বিশাল হই চই শুরু হয়ে গেল। বড় বড় রেকর্ড কোম্পানি তাঁর সিডি বের করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো, প্রথম সিডি মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হলো। মানুষের মুখে মুখে সুজান বয়েল। সুজানকে সুন্দরী এবং স্মার্ট বানানোর জন্য তখন রাজ্যির কোম্পানি উঠে পড়ে লেগে গেল। সুজানের চুলের স্টাইল বদলে গেল, পোশাক আশাক বদলে গেল, চলাফেরা কথাবার্তা বদলে গেল। তাঁর জন্য মেকআপ ম্যান, হেয়ারড্রেসার, সেক্রেটারি কত কিছু। যখন সুজানের কাছ থেকে এক্সপেক্টেশান শুরু হয়ে গেল মানুষের, যেহেতু তিনি আই ড্রিমড এ ড্রিম গেয়ে মাতিয়ে দিয়েছেন বিশ্ব, তখন কিন্তু সুজানের গান অত ভালো কারও লাগেনি। সুজানের জনপ্রিয়তা আকাশ থেকে পাতালে নেমে গেল।

রানু মন্ডল, স্টেশানে পড়ে থাকেন, রাস্তায় রাস্তায় ঘোরেন, লোকে তাঁকে ভারসাম্যহীন বলে,তাঁর মলিন কাপড়, তাঁর উস্কোখুস্কো চুল, তাঁর দারিদ্রে খাওয়া শীর্ণ শরীর। তিনি যখন গান গাইছিলেন, তাঁর কাছে কারও কোনও এক্সপেক্টেশান ছিল না। কিন্তু যখন চমৎকার গেয়ে ফেললেন ‘এক পেয়ার কা নাগমা হ্যায়’ , খুব দরদ দিয়ে গেয়ে ফেললেন, লোকের কোলাহল, ফোনের শব্দ, রেলগাড়ির শব্দ কিছুই যাঁর মগ্নতাকে নষ্ট করতে পারেনি আর সেই গান রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গেল, মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়লো তাঁর ওপর। তাঁর বাড়ি খুঁজে বার করা, তাঁর সাক্ষাতকার নেওয়া, তাঁকে দিয়ে গান গাওয়ানো, রেডিও টেলিভিশন — কী না হচ্ছে! তাঁর বাড়িতে ভিড় লেগেই আছে। ব্যস রানু মণ্ডলের চেহারা বদলে দেওয়া হলো। তাঁর চুল কালি করানো হলো, মুখে স্নো পাউডার মাখানো হলো, খসখসে চামড়ায় তেল সাবান পড়লো। গায়ের নোংরা মলিন শাড়ি খুলে ফেলে ঝলমলে শাড়ি পরানো হলো। একেবারে হুবুহু লতা মুংগেশকার বলে বলে যারা পাগল হচ্ছিল, তারা হয়তো লক্ষ করছে যতটা ভাবা হয়েছিল, রানু মণ্ডল ততটা নন।

এক্সপেক্টেশান না থাকলে যে জিনিসটা প্রচণ্ড ভালো লাগে, এক্সপেক্টেশান থাকলে সেই একই জিনিসে কিন্তু মন ভরে না। রানু মন্ডল অবশ্যই ভালো গান গান। কিন্তু তিনি যদি লতা মুংগেশকারের মতো গাইতে না পারেন এখন, তাহলে কিন্তু বেশিদিন তাঁকে মানুষের ভালো লাগবে না।”

সম্পর্কিত খবর