বিজেপি আরেসেসের লোকেরা বলে, নিকাল যা ইহা সে: বললেন তসলিমা নাসরিন

বাংলাহান্ট ডেস্ক: বাংলাদেশী লেখিকা তসলিমা নাসরিন। সমাজের বিভিন্ন দিক নিয়ে বারবার মন্তব্য করেছেন অকপটে। বাংলাদেশ থেকে দীর্ঘ ২৫ বছর নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি রয়েছেন ভারতে। এবার নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে মন্তব্য করলেন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিজেপিকে নিয়ে। তার মন্তব্য তুলে ধরা হল নীচে।

“ব্যাপারটা এমন, বিজেপি যদি বলে সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, পশ্চিমদিকে অস্ত যায়, আমিও যদি বলি সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, পশ্চিমদিকে অস্ত যায়, তাহলেই লোকেরা আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখাবে আর বলবে, ছি ছি ও তো বিজেপি।

সমানাধিকারের ভিত্তিতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবি করছি আশির দশক থেকে । বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে বৈষম্যমূলক ধর্মীয় আইনের কারণে সব ধর্মের মেয়েরাই ভুগছে কিনা। কিন্তু ভারতেও যখন একই অভিন্ন দেওয়ানি বিধির পক্ষে বলছি, তখনও লোকেরা আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখায় আর বলে, ছি ছি ও তো বিজেপি।
বিজেপি কেন? কী হয়েছে?
বিজেপিও অভিন্ন দেওয়ানি বিধির দাবি করে।
এই হলো উত্তর।

আমার দেশের সংখ্যালঘুরা যেভাবে নির্যাতিত হয়, যেভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে দেশ ত্যাগ করে,তা বর্ণনা করে লজ্জা উপন্যাসটি লিখেছি। লজ্জা মূলত মানবাধিকারের পক্ষে লেখা একটি মানবিক দলিল। কিন্তু এটি লিখেছি বলে উদারনৈতিক বলে পরিচিত লোকেরা সমস্বরে যুগের পর যুগ আমার দিকে ঘৃণাভরে আংগুল তুলে বলেছে, ছি ছি ও তো বিজেপি।
‘৯৩ সালে আমার লজ্জা উপন্যাসটির জাল বই বের করে ভারতের রাস্তা ঘাটে ট্রেনে বাসে বিক্রি করেছে বিজেপি। আমার কোনও অনুমতি নেয় নি। আমাকে কোনও রয়্যালটিও দেয়নি। একজন লেখকের জন্য এ বিরাট অর্থনৈতিক ক্ষতি। কিন্তু লোকে কী বললো? আঙ্গুল তুলে আমাকে দেখিয়ে বললো, ছি ছি ও তো বিজেপি। ওর বই বিজেপি পাইরেট করেছে।
বিজেপি পাইরেট করলে বিজেপি অন্যায় করেছে, আমার ক্ষতি করেছে, এতে আমার বিজেপি হওয়ার কী হয়েছে?
বিজেপি তোমাকে সাপোর্ট করে, সে কারণেই তুমি বিজেপি।
এই হলো উত্তর।

হিন্দু ধর্মের নারী-বিরোধী কোনও সংস্কৃতির সামান্য সমালোচনা করলেই বিজেপি আরেসেসের লোকেরা বলে, নিকাল যা ইহা সে।
কিন্তু আমি তো দুনিয়ার সব নারী বিরোধী ধর্ম সংস্কৃতি আর পুরুষতন্ত্রের সমালোচনা করিই। সে ফতোয়া দিক, রাজ্য ছাড়া করুক, বা দেশ ছাড়া করুক আমাকে, পরোয়া করি না। সে কারণেই সব রাজনৈতিক দলের চক্ষুশূল আমি। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামাতে ইসলামি, কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি সমস্ত দল নিজেদের তসলিমা-বিরোধী পরিচয় নিয়ে গর্ববোধ করে। ভারতেও তাই। সিপিএম আমাকে তাড়িয়েছে রাজ্য থেকে, কংগ্রেস তাড়িয়েছে দেশ থেকে, তৃণমূল বাংলায় ঢুকতে দেয় না, বিজেপি দু’বার এসেই একবার এক বছর থেকে কমিয়ে আমার রেসিডেন্স পারমিট দু মাস করলো, আরেকবার এসে এক বছর থেকে কমিয়ে তিন মাস করলো । এইসব উনাদের চোখ এড়িয়ে যায়। চোখে পড়ে আমি যদি নিজের মত প্রকাশ করতে গিয়ে বলি ৩৭০ নামের সাময়িক ধারাটি বাতিল করা উচিত ছিল, তবে বাতিল করার পদ্ধতিটি গণতান্ত্রিক হলে ভালো হত। সঙ্গে সঙ্গে আঙ্গুল তুলে বলে উঠলো, ছি ছি ও তো বিজেপি।
কেন, বিজেপি হওয়ার কী হলো এতে?
বিজেপি কুমতলব নিয়ে ৩৭০ রদ করেছে। তুমি তাদের সাপোর্ট করছো।
কিন্তু আমার তো কোনও কুমতলব নেই বর্তমান পরিস্থিতিতে কাশ্মীরি জনগণ কী করে শিক্ষা স্বাস্থ্য স্বনির্ভরতা স্বাধীনতা ইত্যাদি পাবে তা নিয়ে ভাবায় এবং শুভকামনা করায়!

৪৫ টা বই লিখলাম সেকুলারিজম,বিজ্ঞান মনস্কতা, মানবাধিকার, নারীর সমানাধিকার, বাক স্বাধীনতা ইত্যাদির পক্ষে, এবং ধর্ম ,ধর্মীয় অন্যায় অনাচারের বিপক্ষে। তারপরও আমি নাকি কোনও একটা ধর্ম ভিত্তিক কোনও দলের সমর্থক! কেন ? যেহেতু সেই দলটি আমাকে সমর্থন করে। কেন এই ধারণা জন্মালো? যেহেতু তারা লজ্জা উপন্যাসটি পছন্দ করে।
লজ্জা তো সবারই পছন্দ করার কথা! আমি দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় থেকে এসে সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়িয়েছি।
ভারতে আমাকে তারাই লজ্জা উপন্যাস লেখার জন্য ঘৃণা করে, যারা ঠিক আমার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় থেকে এসে সংখ্যালঘুর পাশে দাঁড়ায়।
হিপোক্রেসি আর কাকে বলে!

যারে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা।

আমি যা কিছুই বলি না কেন, করি না কেন, যত ভালোই তা হোক না কেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতো আমাকে বাতিল করার বয়কট করার আমাকে অবজ্ঞা করার অপমান করার আমাকে তুচ্ছ করার তাচ্ছিল্য করার জন্য তথাকথিত উদারনৈতিক নামধারী লোকেরা সদা সর্বদা এক পায়ে খাড়া। কী বাংলাদেশে কী ভারতে, তসলিমা-বিরোধী বা তসলিমা-বিদ্বেষী হওয়া যেন জাতে ওঠার প্রথম ধাপ। আমি একদিকে ভালোই আছি, আমার কোনও জাতের বালাই নেই।”

সম্পর্কিত খবর