ইন্দ্রানী সেন,বাঁকুড়া: ‘টেরাকোটার দেশ’ বাঁকুড়ার কুমোড় পাড়া আজ বার্ষিক উৎসবে মেতেছে। একমাস কাজ বন্ধ রাখার পর আজ কাজ শুরুর দিন।পাঁচমুড়ার কুমোর পাড়ায় বর্তমানে ৭০ টি পরিবারের কয়েকশো মানুষ এই পেশায় সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত।এদিন ঐ গ্রামে গিয়ে দেখা গেল, ‘চাক বা চাকা পুজো’ ঘিরে পুরো গ্রাম মাতোয়ারা। ঐতিহ্য আর আধুনিকতার মেলমন্ধনে এক দিকে যেমন কুল পুরোহিত সুসজ্জিত কুমোড়ের চাকা তে ফুল দিয়ে বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজার্চনা সারছেন অন্যদিকে সাউণ্ড বক্স থেকে গান ভেসে আসছে।সব মিলিয়ে উৎসবের মেজাজ পুরো পাঁচমুড়া জুড়ে।
উল্লেখ্য, প্রাচীন প্রথানুযায়ী চৈত্র সংক্রান্তির পর থেকে পুরো বৈশাখ মাস জুড়ে বন্ধ থাকে কুমোর পাড়ার মাটির কাজ। তখন আর কুমোরের চাকা ঘোরে না। তৈরি হয় না কোন ধরণের মাটির জিনিসপত্র। দীর্ঘ এক মাস বিশ্রামের পর জ্যৈষ্ঠ মাসের কোন এক বিজোড় শনিবারে কুমোরের চাকাতে বিশেষ পুজা পাঠের মধ্য দিয়ে নতুন করে শুরু হয় মাটির কাজ। কেন এই সময়েই বন্ধ রাখা হয় কাজ এই বিষয়ে বিশিষ্ট লোক গবেষক ও সাহিত্যিক স্বপন কুমার ঠাকুর বলেন,”
প্রথমত বৈশাখ মাস শিবের মাস। চৈত্র সংক্রান্তি থেকে বৈশাখী সংক্রান্তি পর্যন্ত এই সময় পর্বটা হল একটা বিস্তার। যে চাকাতে কুমোড় রা জিনিস পত্র তৈরী করেন তা নারায়ণের চক্র।কুম্ভকার সম্প্রদায়ের একাংশের মতে, বংশ পরম্পরা গত ভাবে এই সময় কাজ বন্ধ রাখার নিয়ম আছে এটা হলো ওদের বিশেষ প্রথা।
দুই ওরা নিজেদের শিবের সন্তান বলে মনে করেন।যে লাঠি দিয়ে ওই চাকাটা ঘোরানো হয় তা শিবের ত্রিশূল বলে ওরা মনে করে। কারন শিবের বরপুত্র হলেন রুদ্রপাল। এই রুদ্রপালের বংশধর হলেন কুম্ভকার সম্প্রদায় তাই ওনার স্মরণে এই এক মাস ওরা কাজ বন্ধ রেখে দেয়। এই সময় কাজ বন্ধ রাখার বৈজ্ঞানিক কারন হিসাবে যেটা মনে করা হয় এই সময় মাটিকে বিশ্রাম দেয় এই সময় মাটি রস শূন্য হয়।কাজ করতে অসুবিধা হয়। অন্যদিকে লোকপুরান অনুযায়ী শিবের বর যাত পুত্র রুদ্রপালের বংশধর হল এই কুম্ভকার সম্প্রদায়। মাটি পোড়ানোর অধিকার একমাত্র রুদ্রপালের বংশধর এই কুম্ভকার সম্প্রদায়ের আছে। অন্যদিকে লোকায়ত মতে শিব ও পার্বতীর বিয়ের সময় এই কুম্ভকার সম্প্রদায় বিয়ের যে মাটির ঘট বা কলসী তা তৈরী করে দেন। সেই সূত্র ধরেই শিব সন্তুষ্ট হয়ে শিবের মানস পুত্র রুদ্রপাল কে বর দিয়েছিলেন।" অন্যদিকে অপর এক গবেষক সৌমেন রক্ষিত বলেন,"লোককথা অনুযায়ী এক মুনি ও উর্বশীর ঔরসে নয় সন্তানের জন্ম হয়। এই নয় সন্তানই মর্তে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের । বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে এই সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁদের আরাধ্য দেবতার পুজো করে থাকেন”।
পাঁচমুড়ার বাসিন্দা মৃৎশিল্পী তাপস কুম্ভকার বলেন,”চৈত্র মাসের ২৮ তারিখে চাকাটিকে সুন্দর করে সাজিয়ে তার মাথায় বেশ কিছুটা মাটি বসিয়ে এক পাক ঘোরানো হয়। এভাবে ঘোরার ফলে ওই মাটি একটি শিব লিঙ্গের আকার ধারণ করে। এই অবস্থায় পুরো বৈশাখ মাস রেখে দেওয়া হয়।পরে জ্যৈষ্ঠ মাসের এক বিজোড় শনিবার সেই শিব লিঙ্গের আকৃতি বিশিষ্ট মাটিকে সুন্দর করে সাজানোর পর কুলপুরোহিত ডেকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে পুজো করা হয়। এর পর থেকেই সারা বছরের প্রয়োজনীয় মাটি সংগ্রহের কাজ শুরু হয়।” বিশিষ্ট শিক্ষক ও পাঁচমুড়া গ্রামের মৃৎশিল্পী বিশ্বনাথ কুম্ভকার বলেন,” কুমোর পাড়ায় এই রীতি দীর্ঘদিনের। একাধারে এই শিল্পের সঙ্গে মানুষরা সারা বছর নিরবিচ্ছিন্ন কাজ করার পরে ওই একটা মাস বিশ্রামের সুযোগ পান। অন্যদিকে নতুন বছরে যার সাহায্যে মূলত জীবিকা নির্বাহ হয় সেই চাকাটিকে দেবজ্ঞানে পুজো করা হয়।”