কোথায় যেন সব পূজোর এবং রাজবাড়ির ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছে। তবুও সেই স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছেন রাজ পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। শুধু মায়ের পুজোটাই হয়। তবে আর সেই টপ্পা,যাত্রা গানের আসর কিন্তু বসে না। তবে সেই স্মৃতি কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন রাজবাড়ীর দশম উত্তরসুরি বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তীর নাতনি বৈশাখী চক্রবর্তী।
সৌতিক চক্রবর্তী,বোলপুর,বীরভূমঃ যে রাজবাড়িতে আগে পা ফেললেই পা কাঁপতে শুরু করতো। বুকে থাকতো দুরু,দুরু ভয়। গোটা শরীর হয়ে যেতো ঠাণ্ডা। বুটের বিকট শব্দে কেঁপে উঠতো রাজবাড়ি চত্বর। কী জানি বাবা কিছু ভুল হলেই কখন রাজামশাই কী শাস্তি দিয়ে বসবেন? তা কে জানতো। এই ভয় রাজবাড়িতে আগে থাকলেও এখন আর তা নেই।কেননা রাজবাড়িতে রাজার বংশ ধরেরা থাকলেও নেই রাজপাঠ। কালের নিয়মে এখন সব অতীত। বীরভূম জেলার দুবরাজপুরে আজ শুধু পড়ে আছে জরাজীর্ণ একটা অট্টালিকা। এই রাজপরিবারে দূর্গাপূজো শুরু হয়েছিল ১২৪০ সালে। কিন্তু শুরুর সেই দূর্গাপূজোর জাঁকজমক আজ হয়তো নেই। কিন্তু আজও পরম্পরা অনুযায়ী হয়ে আসছে পূজো। এই বছর হেতমপুর রাজবাড়ির দূর্গাপূজো ১৮৫ বছরে পা দিচ্ছে।
আর মাত্র কিছুদিন বাকি বাঙালির প্রাণের উৎসব দূর্গাপূজোর। ঢাকের কাঠি ইতিমধ্যেই পড়ে গেছে। শহরের থিম পূজোর মণ্ডপ গুলিতেও তোড়জোড় প্রায় শেষের দিকে। মেঠো পথে গেলেই কাশফুল,শিউলি ফুলের মাথা নড়ানোতে বোঝা যাচ্ছে মায়ের আগমন বার্তা। আকাশে পেঁজা তুলোর মতো শরৎ’এর মেঘ বলতে শুরু করে দিয়েছে মা আসছেন। যখন বারােয়ারি থিম পুজোর জৌলুসের রমরমা,তখন ঐতিহ্যবাহী পুজো আজও মানুষের মন কাড়ে। এক হারিয়ে যাওয়া দিনের স্বাদ যদি কেউ পেতে চান তাহলে পূজো চারদিনের ভিতরে অবশ্যই তাঁকে আসতে হবে হেতমপুর রাজবাড়িতে। কিন্তু সেখানে কতটা ব্যস্ততা রয়েছে? তা দেখতেই ওই রাজবাড়ীতে পা রাখেন আমাদের প্রতিনিধি।
জানা গেছে, ১২৪০ সালে এই পুজো শুভারম্ভ করেছিলেন রাজা রাধানাথ চক্রবর্তী। ওনার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল রাজবাড়িতেই মায়ের জাঁকজমক ভাবে পুজো করা হবে। কিন্তু তিনি ঈশ্বরের কাছে পরাজিত হলেন। আকস্মিক ভাবে তার পুত্র গঙ্গা নারায়ণ চক্রবর্তীর মৃত্যু হওয়ায় তিনি রাজ বাড়িতে আর পুজো করার সাহস পাননি। পরবর্তীতে রাজ বাড়ির চত্বরে মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পুজো চালিয়ে যান মেয়ে রুক মনি দেবী। তাঁর নামেই এই পুজোর সংকপ্ল হয়ে আসে। রুকমনি দেবী মুন্সেফ বাড়ির বউ,সেই কারণে ওনাকে মুন্সেফ ঠাকুরানী বলা হত। তাই এই পুজো অনেকের কাছে মুন্সেফ ঠাকুরানীর পুজো নামেও পরিচিত। রাজার আমলে পুজো হতো রাজোকীয় ভাবে । পুজো চার দিন ধরে বহু গ্রামের মানুষ রাজবাড়িতে পাত পেরে খাওয়া দাওয়া তো করতোই সঙ্গে চলতো,টপ্পা,পুতুল নাচ যাত্রা সহ নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। আয়োজনে কোন খামতি থাকতো না। কিন্তু কালের নিয়মে বর্তমানে এখন তার জৌলুস হারালেও রাজবাড়ীর দুর্গাপুজোর ঐতিহ্য আছে সেই একরকম।
২০১৯ সালে তথা এই বছর ১৮৫ তম বর্ষে এই দুর্গাপুজোর দায়িত্বভার গ্রহণ করেছেন রাজবাড়ী দশম উত্তরসুরি বিশ্বরঞ্জন চক্রবর্তীর নাতনি বৈশাখী চক্রবর্তী। পুজোর দায়িত্বভার তিনিই এবার নিয়েছেন। তবে তিনি পূজোতে কিছুটা হলেও অভিনবত্ব আনার চেষ্টা করেছেন। তিনি জানান,“এবছর প্রথম আমি দুর্গা প্রতিমাকে ডাকের সাজে সাজাতে চলেছি। তবে দুর্গা প্রতিমার সাজের ক্ষেত্রে পরিবর্তন হলেও শতাধিক বছরের ঐতিহ্যবাহী পুজোর কোথায় কোন পরিবর্তন আনা হবে না। প্রাচীন ঐতিহ্য মেনেই পুজো দেওয়া হবে, বংশ পরম্পরার ঐতিহ্য মেনেই রক্তহীন অর্থাৎ কোনরকম প্রাণ বলি ছাড়াই এই পুজো হবে। তবেই রীতি মেনে সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমীর দিন মন্ডা বলি দেওয়া হবে।” জানা গেছে,সপ্তমীর দিন ১ কেজি ওজনের মোন্ডা, অষ্টমীর দিন ২ কেজির মোন্ডা এবং নবমীর দিন ১ কেজি ওজনের মোন্ডা বলি দেওয়া হয়।
কোথায় যেন সব পূজোর এবং রাজবাড়ির ইতিহাস হারিয়ে গিয়েছে। তবুও সেই স্মৃতি আঁকড়ে রেখেছেন রাজ পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম। শুধু মায়ের পুজোটাই হয়। তবে আর সেই টপ্পা,যাত্রা গানের আসর কিন্তু বসে না। তবে সেই স্মৃতি কে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বৈশাখী চক্রবর্তী। তিনি তার সামর্থ্যের মতো পুজো চালিয়ে যাচ্ছেন রাজ বাড়ির রীতি মেনে। এই পুজোর বৈশিষ্ট্য হল, রাজবাড়ির পুজো সুচনা আগে হয়। তারপরেই দুবরাজপুর এলাকার পারিবারিক থেকে ক্লাব সমস্ত পুজো শুরু হয়।
প্রসঙ্গত, বিগত ১০ বছর ধরে এই দুর্গাপুজো একপ্রকার চাপা পড়ে গিয়েছিল বলাই চলে । কারণ এই দীর্ঘ সময় রাজকন্যা বৈশাখী চক্রবর্তীর পিতা অসুস্থ ছিলেন। সেই কারণেই এই পুজোর দায়িত্বে যারা ছিলেন তারা ছোটখাটো করে পূজো পরিচালনা করে আসছিলেন । ফলে তো বলাই চলে,১০ বছর পর আবার নতুন করে রাজকন্যা বৈশাখী চক্রবর্তীর হাত ধরে হেতমপুর রাজবাড়ীর সুপ্রাচীন দুর্গাপুজো হচ্ছে স্বমহিমায়।
নেই রাজোকীয়তা। আছে শুধু স্মৃতি আর স্মৃতি। রাজবাড়ির চার দেওয়ালে রয়েছে সেদিনের পুজোর হৈ- হুল্লোরের নানা কাহানী। সেগুলো যেন বর্তমান রাজ বাড়ির পরিস্থিতির করুন কাহিনীকে পরিহাস করে।