নেতাজীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল হয়তো অনেক আগেই!

 

নেতাজি গবেষক পৃথ্বীষ দাসগুপ্ত

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারত তথা বাঙালির হৃদয়ের এমন একজন মানুষ যার চির উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি এবং স্বার্থহীন দেশ প্রেমের জোয়ারে আজও উদ্বেলিত সমগ্র ভারতবাসীর অন্তর। কিন্তু কি হলো শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রিয় নেতাজীর ?এই কালজয়ী প্রশ্নের সাথে সাথেই কিভাবে হল এবং কেন হল এই প্রশ্নগুলো কিন্তু একইসাথে উদ্বেলিত হয় আমাদের হৃদয়। এই প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তর আমরা আদৌ কোনদিনও জানতে পারবো কিনা সেটা নিয়েই এখন তৈরি হয়েছে অনেক সংশয়। আমরা সকলেই জানি জাপানের, তাইহোকু সেনা বিমান ঘাঁটিতে নেতাজির বিমান ,দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল বলে প্রচারিত আছে।

কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে ওই বিমান দুর্ঘটনায় নাকি শুধুমাত্র নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ই দগ্ধ অবস্থায় মৃত্যু হয়েছিল, ।অথচ বেঁচে গিয়েছিলেন কিন্তু বিমানে সফররত নেতাজির অনান্য বিশ্বস্ত সহযাত্রীরা।যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ক্যাপ্টেন হাবিবুর রহমান। যিনি ছিলেন নাকি নেতাজী র শেষ সময়ে একমাত্র সাথী ।মূলত হাবিবুর রহমান ই সবাইকে জানান নেতাজী মারা গেছেন এবং তার মৃত্যুর কারণ হলো বিমান দুর্ঘটনা।

IMG 20200123 WA0019

কে এই হাবিবুর রহমান? যদি পিছনের দিকে তাকাই তাহলে আমরা দেখতে পাব হাবিবুর রহমান জন্মে ছিলেন জম্মু-কাশ্মীরে। শিক্ষা জীবন শেষ করে 15 জুলাই 1936 যোগদান করেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ার 2nd ব্যাটেলিয়ানে একজন সৈনিক হিসেবে‌। পরে লেফটেন্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি হয়। 15th ফেব্রুয়ারি 1942 সালে মালায়াতে ব্রিটিশ সেনা আত্মসমর্পণ করে জাপানি সেনার কাছে। যুদ্ধবন্দী হিসেবে জেলে ছিলেন তিনি।। পরবর্তীকালে তিনি তিনি নেতাজির ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হন এবং নেতাজির উদ্যোগে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে আজাদ হিন্দ ফৌজ এর নিযুক্ত করাহয়। পরবর্তীকালে ধীরে ধীরে তিনি আজাদহিন্দ ফৌজ এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হন এবং ক্রমশ নেতাজির ছায়াসঙ্গী হয়ে ওঠেন‌।

IMG 20200123 WA0016

1947 সালে স্বাধীনতার সময় হাবিবুর রহমান পাকিস্তান চলে যান।যুক্ত হন পাকিস্তানের সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে।নিযুক্ত হন মূখ্য অ্যাডমিস্টেটর নর্দান অঞ্চল গিলগীট্ ও বালুচিস্থান, পাকিস্তানের অ্যাডিশনাল ডিফেন্স সেক্রেটারি হিসেবে।গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন আজাদ কাশ্মীর কাউন্সিলের ও।তিনি কাশ্মীরকে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার জন্য বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন।আলোচনায় সফল না হলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরের হিন্দু রাজা হরি সিংহ কে ক্ষমতাচ্যুত করার ঘোষণা করেন। মূলত তারপরই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন কাশ্মীরের শেষ হিন্দু রাজা।

জম্মু ও কাশ্মীর আজাদীর লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার জন্য পাকিস্তান সরকার হাবিবুর রহমান কে 1) ফকর-ই- কাশ্মীর, 2) গাজী-ই-কাশ্মীর, 3) ফতে -ই- ভিমবীর।এবং পাকিস্তান আর্মিতে সাফল্যের জন্য আর্মির পক্ষ থেকে হাবিবুর রহমানকে 1) Sitara-e-Pakistan
2) Nishan-e-Imtiaz 3) Tamgha-e-Imtiaz এবং 4) Tamgha-i-Khidmat এর গুরুত্বপূর্ণ সন্মান দেওয়া হয়েছিল।

IMG 20200123 WA0018

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর অপর একজন বিশ্বস্ত ও বিশেষ আস্থাভাজন ছিল আজাদহিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল শাহ নওয়াজ খান।
ব্রিটিশ স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে তিনি যুক্ত হন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। এরপর, ক্যাপ্টেন পদে নিয়োগ, সিঙ্গাপুর পোস্টিং এবং জাপানের সাথে যুদ্ধের সময় তিনি 1942 সালে যুদ্ধবন্দি হিসেবে গ্রেপ্তার হন। পরে সুভাষচন্দ্র বসুর ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে 1943 সালে তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি INAতে যোগদান করেন।

এক্ষেত্রেও কারাগার থেকে তার মুক্তির ব্যাপারে নেতাজি হস্তক্ষেপ করেছিলেন এবং তাকে আই এন এ তে সামিল করেছিলেন। আজাদহিন্দ ফৌজ যখন বৃটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন তখন মেজর জেনারেল শেহনাজ খান কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল উত্তর-পূর্ব ভারতের। 1945 সালে INA সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর কাছে। গ্রেপ্তার হওয়ার পর 1946 সালে আজাদহিন্দ ফৌজের মেজর জেনারেল শাহ নাওয়াজ খান সহ বাহিনীর একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধাচরণ করার দায়ে লালকেল্লায় প্রকাশ্যেই কোর্ট মার্শাল করা হয়। এই বিচার প্রক্রিয়া চলার সময় মেজর খান সম্পূর্ণরূপে সহিংস পথ ছেড়ে গান্ধীজীর অহিংস পথে চলার কথা ঘোষণা করেন। এরপর জহরলাল নেহেরুর উদ্যোগে মুক্ত হয়ে সক্রিয়ভাবে কংগ্রেসে যোগ দান করেন এবং, সংসদীয় রাজনীতিতে একাধিকবার কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। শাহ নওয়াজ খান চারবার (1951, 1957, 1962 এবং 1971) লোকসভায় নির্বাচিত হন উত্তর প্রদেশের ‘মেরাট’ কেন্দ্র থেকে। 1967 ও 1977 সালের নির্বাচনে তিনি পরাজিত হয়ে ছিলেন কারণ 1965 ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে তার ছেলে মাহমুদ পাকিস্তান আর্মির দায়িত্বে ছিল বলে বিরোধীরা কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন কমিটির পদ থেকে শাহজাহান খানের পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়েছিল। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী এই দাবি খারিজ করে দিয়েছিলেন।

IMG 20200123 WA0017

এখন প্রশ্ন হলো হঠাৎ করে নেতাজির দুজন ছায়াসঙ্গী হাবিবুর রহমান এবং শাহনওয়াজ খান বদলে গেলেন কি করে ? কি করে তারা সুবিধাবাদী রাজনীতিতে ঢুকে পড়লেন ?তাহলে কি নেতাজীর ভাবধারায় সত্যিই অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এরা ? নাকি পুরোটাই ছিল জেল থেকে বেরিয়ে এক উন্মুক্ত পৃথিবী দেখার অভিপ্রয়াস?, প্রশ্ন আছে আরো ,যে নেতাজি অখন্ড স্বাধীন ভারতবর্ষের জন্য মুসলিম ভাইদের নিজের ছায়া সঙ্গী করে রেখেছিলেন, যে নেতাজি হিন্দু মুসলিমের মধ্যে কোনদিনও কোন ভেদাভেদ করেননি, সেই নেতাজির তথাকথিত শেষ মুহূর্তের সঙ্গী হাবিবুর রহমান কেন বিভাজনের পক্ষে ভারত ছেড়ে পাকিস্তান চলে গেলেন? শুধু তাই নয় ,কিভাবে ই বা তিনি মুসলিম জনসংখ্যা বেশি হওয়ার জন্য জম্মু-কাশ্মীর কে জোড় করে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করার জন্য মূখ্য ভূমিকা পালন করেন? কিভাবেই বা ঘৃণ্য চক্রান্ত করে কাশ্মীরের রাজা হরি সিং কে নিজের জায়গা ছেড়ে যেতে বাধ্য করেছিল?

প্রশ্ন আছে হাবিবুর রহমান কেও নিয়েও। আজ যখন প্রায় প্রমাণ হয়ে গেছে যে তাইহোকু বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যু গুজব ছাড়া অন্য কিছু নয়, সেই জায়গা থেকে ঠিক কি প্রমাণের ভিত্তিতে শাহনওয়াজ খান কমিটি 1945 সালের 18 আগস্ট দিনটিতে নেতাজির বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটেছিল বলে মান্যতা দিলেন? তাহলে জহরলাল নেহেরুর মন্ত্রিসভায় গিয়ে তার নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা ভালোবাসা বা সর্বোপরি আবেগ বা প্রেম কি শেষ হয়ে গিয়েছিল ? তিনি কি ভুলে গিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বময় কর্তার দেশের জন্য আত্মত্যাগের ইতিহাস? কেন জহরলাল সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়েও তিনি উপযুক্ত মর্যাদা পাইয়ে দেননি আজাদহিন্দ বাহিনীর হাজার হাজার তার সহ কর্মীদের!

IMG 20200123 WA0015

তাহলে কি নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য এবং মৃত্যু নিয়ে কোন একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের অসম্ভব চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছিলেন তিনি? সেক্ষেত্রে তিনি কি ভুলে গিয়েছিলেন আজাদহিন্দ ফৌজ এর কুড়ি হাজার বীর বিপ্লবীর শহীদ হওয়ার ইতিহাসকে ? এখান থেকে আরও একটা বড় প্রশ্ন কিন্তু উঠে আসে নেতাজির এই হঠাৎ করে অন্তর্ধান এবং তারপর তার কি তাকে জোর করে ভারতবাসীর চোখে তাকে মৃত প্রমাণ করার অপপ্রয়াসের শুরুটা আসলে কবে থেকে ছিল ? তবে কি ষড়যন্ত্রের নিগূঢ় জাল অত্যন্ত সযত্নে বোনা হয়েছিল 1945 সালের 18 আগস্ট এর অনেক আগে থেকেই? জানিনা ভবিষ্যত উত্তর দেবে কিনা, কিন্তু দেশের বীর বিপ্লবী দেশ মায়ের এই বীর সন্তান কে কোন ষড়যন্ত্রী নোংরা হাত শেষ করতে পারেনি বলেই বিশ্বাস করতে আজও বড্ড ইচ্ছা করছে!
তাই কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে একজন অতিসাধারণ নেতাজির ভক্ত সংগ্রাহক এবং দেশপ্রেমিক হিসেবে দাবি ,দয়া করে আর একটা নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করুন ,যারা সঠিকভাবে তদন্ত করে সামনে আনবে নেতাজির অন্তর্ধান আসল রহস্য ।দেশবাসীর সামনে উন্মুক্ত করবে সেই সমস্ত সত্য ,যাকে গলাটিপে হত্যা করার অনেক প্রয়াস হয়েছে হয়ত আমাদের এই ভারত থেকেই ।ভারত মায়ের বিশ্ববন্দিত সেই ছেলের শেষ পর্যন্ত সত্যিই কি হয়েছিল সেটা জানার অধিকার আছে সকল ভারতবাসীর ই। হয় মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট সর্বসমক্ষে উন্মুক্ত করা হোক আর না হলে একটা নতুন কমিটি বা কমিশন গঠন করা হোক যারা সঠিক ভাবে এবং দ্রুততার সাথে নেতাজি সংক্রান্ত সকল ষড়যন্ত্রের রহস্যের উদ্ঘাটন করবে।

Udayan Biswas

সম্পর্কিত খবর