ধর্ম দূরে সরিয়ে রেখে মৃত্যুপথযাত্রী মুসলিম রোগীর জন্য ইসলামী রীতিতে প্রার্থনা চিকিৎসকের

বাংলা হান্ট ডেস্কঃ একদিকে যখন মহামারীর অন্ধকারে ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে মানুষ। একের পর এক অসহায় মৃত্যু দেখতে দেখতে চোখ ভিজে যাচ্ছে কান্নায় গলা বুজে আসছে। তখনই অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে বেশকিছু মানবিকতার নজিরও। হয়তো এই কোভিড কালের পরেও যা থেকে যাবে অনেকের স্মৃতিতে। পরিযায়ী শ্রমিকদের শত শত মাইল হেঁটে চলার মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে যেমন এগিয়ে এসেছিলেন সনু সুদের মতো মানুষেরা। জাতি ধর্ম সমস্ত কিছুকে দূরে সরিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সকলের দিকে। তেমনি বেশকিছু অনন্য নজির তৈরি হচ্ছে প্রতিদিনই। এবার এমনই এক সুন্দর মানবিকতার নজির রাখলেন ডঃ রেখা কৃষ্ণন। নিজের হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ধর্মকে মেনে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর জন্য প্রার্থনা করলেন তিনি। কলমা পড়লেন তার কানে। আফরান চেষ্টার পরেও বাঁচানো যায়নি রোগীটিকে। কিন্তু তার চির নিদ্রার মুহূর্তটি যেন শান্তির হয় এটুকুই প্রয়াস ছিল রেখার। প্রথমে অবশ্য ঘটনাটি সহকর্মী মুস্তাফা ছাড়া আর কাউকেই জানাননি রেখা। কিন্তু নিজের ফেসবুক পোস্টে এ কথা প্রকাশ করে ডাক্তার রেখার মানবিক মুখটি সকলের সামনে তুলে ধরেন সেই বন্ধুই। ইতিমধ্যেই অবশ্য সকলের কাছে যথেষ্ট প্রশংসা পেয়েছেন ডক্টর রেখা কৃষ্ণান।

প্রায় দু সপ্তাহ আগে করোনার উপসর্গ নিয়ে পালাক্করের ওই বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন এক ইসলাম ধর্মাবলম্বী মহিলা। ডক্টর রেখার তত্ত্বাবধানেই ছিলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত করোনার সঙ্গে নিউমোনিয়াও ধরা পড়ে ঐ রোগীর শরীরে। ফলতো নিয়ম মেনেই তাকে ভেন্টিলেশনে পাঠান চিকিৎসকরা। কিন্তু আপনার চেষ্টার পরেও চিকিৎসায় সেভাবে সাড়া দেখছিলেন না রোগী। বরং ১৭ দিন পর থেকে থেকে তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। ফলে শেষ পর্যন্ত রোগীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলে তার ভেন্টিলেটর সাপোর্ট খুলে নেওয়া হয়। এরপর আর বেশিক্ষণ লড়াই চালাতে পারেননি ৫৬ বছর বয়সী ওই মহিলা।

তবে এমতাবস্থায় হঠাৎই মন কেঁদে ওঠে ডিউটিতে থাকা ডাক্তার রেখা কৃষ্ণানের। তার মনে হয়, রোগীর জন্য অন্তত একটু প্রার্থনা করা দরকার তার। তাতে হয়তো বা কিছুটা শান্তি পাবেন ওই রোগী। নিজে আরব আমিরশাহীতে ছিলেন তিনি। যার কারণে ইসলামী রীতি কিছু কিছু জানতেন তিনি। সেই সূত্র ধরেই ঈশ্বরের কাছে রোগীর জন্য প্রার্থনা করেন ডক্টর রেখা। কানে কলমা পড়ে, হাত দিয়ে চোখ বুজিয়ে দেন। রেখা জানান, তার এই প্রার্থনার পর বড় একটি শ্বাস নেন রোগী। আর তারপর সব শেষ। আসলে কোভিড প্রটোকলের কারণে এই মুহূর্তে রোগীর পাশে থাকতে পারছেন না কেউই। তাই শেষ মুহূর্তে সঙ্গী শুধু ডাক্তার এবং নার্সরাই। হঠাৎ করে এই ঘটনায় যেন নিজের মানবসত্তার ডাক শুনতে পান রেখা। তিনি জানান, “আসলে আমি অসহায়ের মত তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি জানিনা ওনার পরিবারের সাথে ওনার শেষ স্মৃতি কি ছিল? আমি তার পবিত্র আত্মার জন্য নিরবে প্রার্থনা করি এবং তার কানে কলমা পাঠ করি। তার মেয়ে বা পরিবারের অন্য কেউ যদি এখানে থাকতেন হয়তো তারাও তাই করতেন। এটা কোন ধর্মীয় ভাবধারা থেকে আমি করিনি বরং করেছি মানবিকতার কারণে।”

হ্যাঁ তারা চিকিৎসক, আমরা তাদের দ্বিতীয় ভগবান মনে করলেও কখনো কখনো ব্যর্থ হতে হয় তাদের। তারা ভেঙে পড়েন অন্তরে অন্তরে। আর সেই কারণেই ফেসবুক লাইভে মর্মান্তিক মৃত্যুর কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন কেউ। কেউবা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে খুঁজে নিতে চান মানসিক শান্তি। রেখা জানিয়েছেন, বিদেশে থাকতে তিনি কখনো ডিসক্রিমিনেশনের শিকার হননি। আর সেই কারণেই আজ তিনি তার শ্রদ্ধাটুকু ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। ইতিমধ্যেই ভাইরাল হয়েছে ওই ফেসবুক পোস্ট। রেখার প্রশংসায় মুখ খুলেছেন বহু মানুষ। হয়তো তাদের মনেও কোথাও বাজছে, “হিন্দু বানেগা না মুসলমান বানেগা, ইনসান কা ওলাদ হ্যায় তু ইনসান বানেগা।”

 

Abhirup Das

সম্পর্কিত খবর