বাংলাহান্ট ডেস্ক : ৩০৩ টি আসন ২০১৯ সালে বিজেপি দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পরই ভারতের রাজনীতি সরগরম হয়ে ওঠে ‘অপারেশন লোটাস’ নিয়ে। কী এই ‘অপারেশন লোটাস’? আর কেনই বা বিজেপি বিরোধী শিবিরে থরহরি কম্প শুরু হয়ে যায় এই নামটি শুনলেই। চলুন জেনে নেওয়া যাক।
কী এই ‘অপারেশন লোটাস’?
ভারতকে সম্পূর্ণ বিরোধী শূন্য করতে বিজেপির তৈরি রাজনৈতিক চক্রবূহ্যের নামই হলো ‘অপারেশন লোটাস’। কী ভবে কার্যকর হয় এই অপারেশন? এই অপারেশনের তিনটি স্তর আছে।
১) নির্বাচনে হেরে গিয়েও পরবর্তী কালে কূটনৈতিক কৌশলে বিজয়ী দলের বিধায়কদের বিদ্রোহ ঘোষণা করানো হয়। তার ফলে সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারায় সরকার।
২) সমর্থন জোগাড় করা হয় বিদ্রোহী বিধায়ক, আঞ্চলিক দল এবং নির্দল বিধায়কদের।
৩) সংখ্যা গরিষ্ঠতা হারানোয় বিধানসভায় হয় আস্থা ভোট। এবং তাতেই বদলে যায় সমস্ত সমীকরণ। বদলে যায় সরকার।
গত ছয় বছরে মোট সাতটি রাজ্যে গেরুয়া শিবির এই অপারেশন চালায়, এবং তার মধ্যে চারটি রাজ্য দখল করে তারা। সাফল্যের হার ৬০ শতাংশ।
বিজেপি কোন কোন রাজ্য দখল করেছে অপারেশন লোটাসে?
১) মধ্যপ্রদেশ : –
২০১৮ সালে ২৩০ টি আসনে বিধানসভা নির্বাচন হয়। কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠতা পায়নি কোনও দলই। কংগ্রেস পায় ১১৪ টি আসন। বিজেপির প্রাপ্তি ছিল ১০৯ টি আসন। বিএসপি এবং নির্দল প্রার্থীদের সমর্থন নিয়ে সরকার গড়ে কংগ্রেস। মুখ্যমন্ত্রী হন কমল নাথ। এরপরই শুরু হয় আসল খেলা। কংগ্রেস নেতা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে হাত করে বিজেপি। ২০২০ সালের ৯ মার্চ সিন্ধিয়া এবং তাঁর সমর্থকরা কমলনাথের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। মাত্র ১০ দিনের মধ্যেই পতন ঘটে কংগ্রেস সরকারের। ক্ষমতায় বসে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হন শিবরাজ সিং চৌহান। জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়া পান কেন্দ্রীয় মন্ত্রীত্ব।
২) কর্নাটক :-
২০১৭ সালের ২২৪টি কর্নাটক বিধানসভা নির্বাচনে ১০৪টি আসন নিয়ে একক বৃহত্তম দল হয় বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথও নেন ইয়েদুরাপ্পা। কিন্তু আস্থা ভোটে হেরে পতন হয় বিজেপি সরকারের। কংগ্রেসের ৮০ জন এবং জিডিএসের ৩৭ জন বিধায়ক নিয়ে সরকার গঠন করেন দেবেগৌড়ার পুত্র কুমারস্বামী। তাঁর শপথ নেওয়ার দিন থেকেই কর্নাটকেও শুরু হয়ে যায় ‘অপারেশন লোটাস।’ ২০১৯ সালে কংগ্রেসের ১২ জন এবং জেডিএসের ৩ বিধায়ক বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ফলে কংগ্রেস-জেডিএস জোটের আসন সংখ্যা কমে দাঁড়ায় ১০১। বিজেপির কাছে ছিল ১০৫টি আসন। আস্থা ভোটে হেরে পদত্যাগ করেন কুমারস্বামী। মুখ্যমন্ত্রী হন ইয়েদুরাপ্পা।
৩) গোয়া :-
একই ছবি দেখা যায় গোয়াতেও। ২০১৭ সালে গোয়ার ৪০টি আসনে বিধানসভা নির্বাচন হয়। কোনও দলই সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করতে পারেনি। ১৭টি আসন নিয়ে বৃহত্তম দল হয় কংগ্রেস। তবে সরকার গড়ার চাবিকাঠি ছিল আঞ্চলিক ও নির্দলদের হাতে। ১৩ টি আসন পেয়েও নির্দল বিধায়কদের সমর্থনে সরকার গঠনের দাবি জানান মনোহর পরিক্কর। তৎকালীন গোয়ার রাজ্যপালও বিজেপিকে আমন্ত্রণ জানান সরকার গঠন করতে। মুখ্যমন্ত্রী হন মনোহর পরিক্কর।
৪) অরুণাচল প্রদেশ :-
২০১৪ সালের নির্বাচনে ৬০ টি আসনের মধ্যে ৪২টি আসন পায় কংগ্রেস। কিন্তু দু’বছরও সরকার টেকাতে পারেনি তারা। ২০১৬ সালে মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডুর ৪২ জন বিধায়কই কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দেয় পিপিএতে (PPA)। বিজেপির সমর্থনে সরকার গড়ে পিপিএ।
কোথায় ব্যর্থ ‘অপারেশন লোটাস’ ?
অপারেশন লোটাস যে সবসময় সফল হয়েছে তা কিন্তু নয়। আছে ব্যর্থতার নজিরও। ৩ রাজ্যে কিন্তু বিফল হয় বিজেপি।
১) রাজস্থান :-
২০১৮ সালে বিধানসভা নির্বাচনে ১০০ টি আসন জেতে বিএসপি। বিএসপি-কংগ্রেস জোট নির্দলকে সঙ্গে নিয়ে সরকার গঠন করে। এই পরিস্থিতিতে রাজ্য রাজনীতিতে গুরুত্বহীন হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করে সচিন পাইলট। তিনি ২০২০ সালের জুলাই মাসে ১৮ জন বিধায়ককে নিয়ে আশ্রয় নেন গুরুগ্রামের একটি হোটেলে। এদিকে দলের বাকি বিধায়ক এবং নির্দলদের নিয়ে আত্মগোপন করেন গহলৌতও। এদিকে পাইলটের মান ভাঙান প্রিয়াঙ্কা গান্ধী। এই যাত্রায় রোধ করা যায় গহলৌত সরকারের পতন। ব্যর্থ হয় বিজেপি।
২) উত্তরাখণ্ড :-
২০১২ সালে ত্রিশঙ্কু হয় উত্তরাখণ্ড। ৩২ টি আসন জিতে একক বৃহত্তম দল হয় কংগ্রেস। বিজেপির ঝুলিতে থাকে ৩১ আসন। ২০১৪ সালে বিজয় বহুগুণাকে সরিয়ে কংগ্রেস মুখ্যমন্ত্রী করে হরিশ রাওয়াতকে। ২০১৬-তে ৯ জন বিধায়ককে নিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন বহুগুণা। বিধানসভার স্পিকার ওই ৯ বিধায়ককে বরখাস্ত করলে জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। মামলা হয় সুপ্রিম কোর্টে। আদালতের নির্দেশে ৯ বিধায়ককে বাদ দিয়েই হয় আস্থা ভোট। জিতে যান রাওয়াত। বেঁচে যায় তার সরকার। হার মানে বিজেপি।
৩) মহারাষ্ট্র :-
২০১৯ সালে ২৮৮ আসনে বিধানসভা নির্বাচন হয় মহারাষ্ট্রে। বিজেপি পেয়েছিল ১০৫ টি আসন। এবং তাদের জোর সঙ্গী শিবসেনা পায় ৫৬টি আসন। কিন্তু গোল বাঁধে তারপরেই। মুখ্যমন্ত্রী কে হবে সেই নিয়ে মতবিরোধ হয় শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে। সাথে সাথেই উদ্ধব শরদ পাওয়ারের এনসিপি (NCP)-এর সঙ্গে জোট করে সরকার গড়ার পরিকল্পনা করে। পাল্টা চাল দেয় বিজেপিও। অজিত পাওয়ারকে দিয়ে ভাঙন ধরায় এনসিপিতে। এরপর অজিত পাওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী করে মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। কিন্তু এবার আসরে নামেন অভিজ্ঞ শরদ পাওয়ার। ভেস্তে দেন বিজেপির চাল। ইস্তফা দেন ফড়নবিশ। মুখ্যমন্ত্রী হন উদ্ধব ঠাকরে। এর পরের ঘটনা সবায়েরই জানা।
মহারাষ্ট্রে বাউন্স ব্যাক ‘অপারেশন লোটাস’
২০২২ সালে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন শিবসেনার একনাথ শিন্ডে। ৪২ বিধায়ককে নিয়ে ডেরা বাঁধেন গুয়াহাটি। নির্বিষ হয়ে যায় শরদ পাওয়ারও। উপায়ন্তর না দেখে ইস্তফা দেন উদ্ধব ঠাকরে। নতুন সরকার গড়ে বিজেপি-শিবসেনা জোট। মুখ্যমন্ত্রী হন একনাথ শিন্ডে। উপমুখ্যমন্ত্রী হন দেবেন্দ্র ফড়নবিস।
এরপর কি বাংলা?
প্রবল সম্ভবনা জাগিয়েও ২০২১-এর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে মুখ থুবড়ে পরে বিজেপি। ৭৩টি আসন পায় পদ্ম শিবির। ২১৩ টি আসন পেয়ে বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতা নিয়ে তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী হন দলের সুপ্রিমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী বারবার ইঙ্গিত দিচ্ছেন ২০২৪ এই নাকি হবে বাংলায় বিধানসভা নির্বাচন। তাহলে কি বাংলাতেও আসতে চলেছে ‘অপারেশন লোটাস’? অন্তত শুভেন্দুর মন্তব্যে সরকমই আঁচ পাওয়া যাচ্ছে। তবে সেটা অতটা সহজ হবেনা বাংলার ক্ষেত্রে। বাংলায় সরকার গড়তে হলে কমপক্ষে ১৪৮টি আসন পেতে হবে। অর্থাৎ বিজেপিকে কমপক্ষে ৭১জন বিধায়ককে নিজের দলে আনতে হবে। এই মুহুর্তে বঙ্গ বিজেপির যা করুণ দশা, তাতে এই স্বপ্ন মরিচীকা বলেই মনে হচ্ছে। তবে ২০২৪-এর লোকসভার পরই বাংলার রাজনৈতিক প্রক্ষাপট পাল্টাবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ মহল।