বাংলাহান্ট ডেস্ক: উৎসব আসলেই গোটা শহর আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। সে দুর্গাপূজা হোক কিংবা কালীপুজো কিংবা জগদ্ধাত্রী পুজো ( Jagadhatri Puja ), ক্রিসমাস কলকাতার একটাই ঐতিহ্য লাইটিং। ঠাকুর দেখার জন্য নয় মূলত ভিড় জমে লাইটিংয়ের জন্য। আর এই লাইটিংয়ের কারুকার্য মানেই চন্দননগর। পুজো কিংবা কোনো উৎসব আসল মানেই দলের সদস্যরা ছুটলেন চন্দননগর। আগেভাগে বুক করতে হবে লাইট, নইলে সেরার সেরা লাইটিংটা পাওয়া যাবে না। এটাই সত্য যে চন্দননগরের আলোকসজ্জার যতই প্রশংসা করুন না কেন, ততই কম পড়বে।
বিদেশ থেকেও আজ কলকাতায় ছুটে আসেন বহু পর্যটক। বিশেষ করে উৎসবের মরশুমে হাজির হন তারা। আজ চন্দননগরের আলোকসজ্জা বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছে। আলোর আসল সংজ্ঞা কাকে বলে তা শিখিয়েছে চন্দননগরের লাইটিং। যেখান আজ পুঁথিগত বিদ্যা, বড় বড় ডিগ্রি নিয়েও এই বিষয়ে ফেল হয়ে যাচ্ছেন অনেকে, সেখানে চন্দননগরের কারিগরদের কোনকিছুই লাগে না। তারপরও গোটা শহর আলোয় আলোকি হয়ে উঠছে। কিন্তু আজ এই চন্দননগরের সেরা আলোকসজ্জা তকমা পাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে জগদ্ধাত্রী পুজোর ( Jagadhatri Puja ) কাহিনী। মূলত জগদ্ধাত্রী পুজোর শোভাযাত্রা রয়েছে এর সাথে জড়িয়ে।
আরো পড়ুন : সাত সকালে হাওড়ার শালিমার স্টেশনে লাইনচ্যুত ট্রেন! ভয়ঙ্কর বিপদের মুখে রেল যাত্রীরা
চন্দননগরের আলোকসজ্জার নেপথ্যে কাহিনী:
বিশিষ্ট সূত্র মারফত জানা যায় সেই কাহিনী। সময়টা তখন ১৮ শতকের মাঝামাঝি। সেই সময়ই চন্দননগরে শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল। ভাগীরথী নদীর পশ্চিমে গঙ্গার ধারঘেঁষে চলে গিয়েছে হুগলি জেলা। সেখানেই অবস্থিত এই শহর চন্দননগর। যার পূর্ব নাম ছিল চাঁদ নগর, পরে হয় চন্দন নগর। মূলত ১৮৫৪ সালের নাগাদ রেলপথ চালু হওয়ার পর যাতায়াত ব্যবস্থা যেমন সুবিধের হয়ে ওঠে, তেমনি মানুষের মধ্যে পুজো দেখার হিড়িক জাগে। বিশেষ করে এখানে প্রতিমা নিরঞ্জন দেখার জন্য বাইরে থেকে বহু মানুষ এখানে ভিড় জমাতে শুরু করে। ফলে জগদ্ধাত্রী পুজোর ( Jagadhatri Puja ) খ্যাতি বাড়তে থাকে।
আরো পড়ুন : গাইডলাইন প্রকাশ করুন! রাজ্যকে কড়া নির্দেশ হাইকোর্টের, সমস্যার সমাধান হবে?
আর সেই থেকেই শুরু হয় জনজোয়ার। প্রথমদিকে পুজোর এত খ্যাতি ছিল না, পুজো মন্ডপের সংখ্যাও তখন সীমিত ছিল, ফলে কোন সমস্যা হতো না। তবে পরবর্তীতে যখন জগদ্ধাত্রী পুজো ( Jagadhatri Puja ) বারোয়ারিতে পুজোতে রূপ নিল তখনই শুরু হয় সমস্যা। প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় জনসমাগম বাড়তে থাকে। আর এই জনজোয়ার এবং প্রতিমা নিরঞ্জন ঠেকাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় পূজা কমিটির সদস্যদের। কারণ সেই সময় আলোর অভাবে নানা দুর্ঘটনা ঘটতে শুরু করে। আর তখনই মনে করেন চন্দননগরে আলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
তবে এই আলোর প্রয়োজনীয়তা তখন মেটাবে কিভাবে। তখন তো আসেনি কোনো ইলেকট্রিসিটির ব্যবস্থা আর না এসেছে বিজ্ঞানের কোনো জুড়ি। কিন্তু এই সমস্যা থেকে বাঁচতে চন্দননগরের বাসিন্দারা খুজলেন অন্য পন্থা। শুনলে অবাক হবেন, আলোর ঘাটতি পূরণ করার জন্য ঘুঁটের ব্যবহার করেন। তার জন্য প্রথমে, অনেকগুলি পিতলের বড় গামলায় ঘুঁটে জ্বালিয়ে প্রতিমার সামনে সারিবদ্ধভাবে সাজিয়ে রাখা হত। আর এতে করে ঘুঁটের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠত সেই স্থান।
তবে তাতে করে যতটা আলো উৎপাদন হতো তা চাহিদার তুলনায় নেহাতই কম। তাই এরপর নিতে হয় অন্য পন্থা। বাঁশের মাথায় কাপড় জড়িয়ে তাতে ভালো করে কেরোসিনে ভিজিয়ে মশাল তৈরি করা হতো। সেই মশালের আলোতেই প্রতিমা নিরঞ্জন শুরু হল। তবে মশালের আলোও খুব একটা কার্যকর হলো না। এরপর এই সমস্যা সমাধানে এল হ্যাজাক। তবে অন্যান্য পন্থার তুলনায় হ্যাজাকের আলো যথেষ্ট কার্যকর ছিল। যার আলো অনেকটাই কার্যকরী হয়েছিল এবং যথেষ্ট উজ্জ্বলও ছিল। তবে এই হ্যাজাক বাহক আসতো সুদূর ওড়িশা থেকে।
এরপর দীর্ঘদিন পর ১৯৩৪ সালে চন্দননগরের প্রথম আসে বিদ্যুতের ব্যবস্থা। ঠিক তার চার বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে জগদ্ধাত্রী পুজোতে ( Jagadhatri Puja ) বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবহার শুরু হয়। গোটা মন্ডপ সেজে ওঠে বৈদ্যুতিক আলোর সাজে। আর সেই যে শুরু তারপর থেকে, ধীরে ধীরে সেই আলোর ব্যবস্থা উন্নত হতে থাকে। পাশাপাশি, জগদ্ধাত্রী পুজোয় আলোর রূপ যেন এক অন্য মাত্রা এনে দেয়। সেই থেকেই চন্দননগরের আলোর কারুকার্য জগৎবিখ্যাত।
তবে হ্যাঁ চন্দননগরের এই লাইটিং এর পিছনে রয়েছে আলোকশিল্পী শ্রীধর দাস। যার হাত ধরে আজ আলোর কারুকার্য অন্য সংজ্ঞা পেয়েছে। পাশাপাশি এই আলোর সাজ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।