অ্যামাজনের রুপকথা,যা ধ্বংসের পথে, পর্ব -২

রাজা সাহা :-পরের দিন সকাল সকাল চলে এলাম লিমা বিমানবন্দর । আজ বহু পথ যেতে হবে – ‘LATAM Airlines’-এর বিমান ধরে ‘কুজকো’ বা ‘কুসকো’ শহর হয়ে ৫০ কিমি দূরের ‘উরুবাম্বা’ । দক্ষিণপূর্ব পেরুর ‘Sacred valley of the Incas region’এ উরুবাম্বা নদীর পাড়ে চারপাশে পাহাড় ঘেরা অসমতল খাড়া ছোট্ট শহর ।

 

পথে পরলো তিনটে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রথমে ‘কুয়েঙ্কো’ – কুসকো অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ পবিত্র ধর্মস্থান – একপ্রস্থরের স্তম্ভ । তারপর ‘পুকা-পুকারা’ আর ‘তাম্বোমাচায়’ । এবার আমাদের গাড়ী এসে দাঁড়ালো ইনকা সভ্যতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ‘কোরিকাঞ্চা’ মন্দিরের প্রাঙ্গণে । সূর্য দেবতার উপাসনার মূল কেন্দ্র এই মন্দির । ইনকা আমলে পুরো মন্দিরটা ছিল সোনায় মোড়া । সম্রাট আতাহুয়ালপা-র মুক্তিপণের জন্য মন্দিরের সোনার দখল নেয় স্পেনীয় দস্যুরা । মাথা গোঁজার ঠাই হল উরুবাম্বা শহরের ‘Hotel San Agustin Urubamba’-য় । অ্যাণ্ডিজ পাহাড়ের মাঝে ৮০০০ ফুট উচ্চতার এই শহরে সন্ধ্যা হতেই জাঁকিয়ে ঠাণ্ডা পরলো । শ্বাসকষ্ট থেকে বাঁচতে কোকা ৩০ ও কর্পূরের সাহায্য নিতেই হল । চটপট খেয়ে নিয়ে আশ্রয় নিলাম সটান লেপের নীচে ।

brazil president revokes decree allowing mining in amazon 1024x680

আজ সকাল থেকে সবাই আমরা উত্তেজনায় টানটান । দেখবো নয়া দুনিয়ায় সপ্তম বিস্ময়ের অন্যতম ‘মাচুপিচু’ । ‘উরুবাম্বা’র হোটেল থেকে বাসে করে চলে এলাম ইনকা রেলের ‘ওলানতায়তাম্বো’ স্টেশন – উরুবাম্বা নদীর পাড় ধরে দেড় ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ৩৮ কিমি দূরে অন্তিম স্টেশন ‘আগুয়াস ক্যালিয়েন্তেস’ ।

টিকিটের খরচে সীটে বসেই পেয়ে গেলাম গরম চা/কফি সঙ্গে হালকা প্রাতরাশ । স্টেশন পেরিয়ে টুরিস্টদের স্যুভেনির বাজার শেষে বাস স্ট্যাণ্ড । আধ ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম ‘মাচুপিচু’র প্রবেশ তোরণের সামনে ।

 

1000x 1
1000x 1

অ্যাণ্ডিজ পর্বতমালার উরুবাম্বা নদী উপত্যকার প্রায় ৮০০০ ফুট উচ্চতায় পাহাড়ের এক খাঁজে ইনকা সম্রাট পাচাকুটি ১৪৫০ সাল নাগাদ নির্মান করেন দুর্গ ঘেরা এক প্রাসাদ । সমগ্র পেরু জুড়ে স্পেনীয় ঔপনিবেশিকদের লুন্ঠনের হাত থেকে প্রাসাদকে রক্ষা করতে এক শতাব্দী পার হতে না হতেই ইনকা উপজাতির মানুষ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় এই অপূর্ব প্রাসাদ ।

স্পেনীয় এবং বহির্বিশ্ব থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে কয়েক শতাব্দী জুড়ে পরিত্যক্ত এই প্রাসাদ পরিনত হয় এক দুর্গম ধ্বংসাবশেষে । সর্বোৎকৃষ্ট ইনকা শৈলীতে নির্মিত সভ্যতার বিশিষ্টতম এই মন্দির ১৯৮১ সালে পেরুর সর্বাপেক্ষা বিশিষ্ট ঐতিহাসিক নিদর্শণ, ১৯৮৩ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট এবং ২০০৭ সালে পৃথিবীর সাম্প্রতিক সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম হিসাবে স্বীকৃতি অর্জন করে নেয় ।

amazon 13 1

জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা এবং ইনকাদের নির্ঘন্টের জন্য ব্যবহৃত পবিত্রতম পাথরকে বলা হয় ‘ইন্তিওয়াতানা’ । সূর্যঘড়ি ও শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের জন্যও এই পাথর ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয় । গাইডের নির্দেশে এবার চলে এলাম মাচুপিচুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূর্য দেবতা ‘ইন্তি’-র মন্দিরের সামনে ।

 

শুধুমাত্র পুরোহিত এবং উচ্চ আভিজাতদের প্রবেশাধিকার ছিল এই মন্দিরে । মন্দিরের সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় বৈশিষ্ঠ হল বহিঃদেয়াল যুক্ত অর্ধবৃত্তাকার এক মিনার । মিনারের ভেতরে রাখা আছে এক প্রস্তরখণ্ড বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের বেদী । দেওয়ালের গবাক্ষ – গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অয়নান্ত বিন্দুর সাথে সারিবদ্ধ । মন্দিরের নীচের তলায় মাচুপিচুর তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দ্রষ্টব্য ‘Room of the three windows’ ( অন্য নাম Temple of the three windows) । সেটা দেখতে এখানকার পবিত্র চকের সামনে এসে ভীড় করলাম । শক্তপোক্ত চতুস্কোন একটা বেশ বড় ঘরের মূল দেওয়ালের ওপরের দিকে তিনটে জানালা । এই জানালাগুলো দিয়ে মাচুপিচুর চারপাশের পাহাড় এবং সূর্যোদয় দেখে নেওয়া যায় । পাশের ঘরেই মূল মন্দির – সমস্ত ধর্মীয় ও সামাজিক ক্রিয়াকর্ম অনুষ্ঠিত হতো ।

brazil president revokes decree allowing mining in amazon 1024x680

বুদ্ধিমত্তার সাথে নির্মিত এই মন্দির নগর পরিকল্পনা ও নির্মাণের এক অত্যাশ্চর্য উদাহরণ । প্রাঙ্গনের উচ্চ ভাগ নগরীয় ও নিম্ন ভাগ ক্ষেত্রজ ।
সন্ধান না পাওয়া ‘ভিটকোশ’ নামের এক শহরকে ঐতিহাসিকরা ইনকা সভ্যতার প্রাচীন রাজধানী হিসাবে বিশ্বাস করতেন । এই বিশ্বাসকে সম্বল করে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও পেরু বিশেষজ্ঞ ‘হিরাম বিনঘাম’ ১৯১১ সালে ভিটকোশের সন্ধানে এক অভিযানের আয়োজন করেন । ‘আর্টিয়াগা’ নামের এক কৃষকের সাহায্যে ভিটকোশের বদলে খুঁজে পান পরিত্যক্ত মাচুপিচু । গাইডের কাছ থেকে সব শুনতে শুনতে ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম অত্যাশ্চর্য এই মাচুপিচু । ঘণ্টা চারেক ধরে পাহাড়ি রাস্তায় ঘরাঘুরির ফলে প্রচণ্ড ক্ষিধে নিয়ে ফিরে এলাম বাসস্ট্যাণ্ডে । রাত করে ফিরে এলাম কুজকো শহরের হোটলে ।

Udayan Biswas

সম্পর্কিত খবর