বাংলা হান্ট ডেস্ক : গত বুধবার রাতে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মেন হস্টেলে’ ঠিক কী হয়েছিল, তা এখনও অজানা। প্রথম বর্ষের পড়ুয়া ‘স্বপ্নদীপ কুণ্ডু’র মৃত্যুকে মোটেও স্বাভাবিক বলে মনে করছেনা তার পরিবার থেকে শুরু করে অধ্যাপক ও সহপাঠীরাও। ইতিমধ্যেই স্বপ্নদীপের মামা র্যাগিংয়ের অভিযোগ জানিয়েছেন যাদবপুর থানায়। আর তারপরেই বৃহস্পতিবার একইরকম ‘বিভীষিকাময়’ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরলেন যাদবপুরের ওই নিহত ছাত্রের এক সহপাঠী অর্পন মাঝি। তিনিও ওই মেন হস্টেলেরই বাসিন্দা।
সূত্র মারফত পাওয়া খবর, অর্পনও প্রথম বর্ষের ছাত্র। স্বপ্নদীপ পড়তেন বাংলা নিয়ে আর তিনি পড়েন জিওলোজি বিভাগে। এইদিন সহপাঠীর মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর অর্পন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘‘ আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমার পরিবার অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা একটি পরিবার এবং আমি আসানসোলে বড় হয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই আমি ভর্তির সময় হস্টেলের জন্য আবেদন করেছিলাম। কিন্তু প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরুর পরের দু-তিন রাতেই হস্টেল আমার মধ্যে বিভীষিকার জন্ম দিয়েছে। এখন আমি অনেক কষ্ট করেই, ধার নিয়ে হলেও মেস খুঁজছি।’’
একটা নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও মেস কেন খুঁজছেন তিনি? অর্পন জানিয়েছেন, ‘‘সমাজের প্রতিটি স্তরে ক্ষমতা প্রদর্শন আছে, কিন্তু যাদবপুর মেন হস্টেলের কিছু দাদাও যে এই একই কাজ করবে তা আমার কল্পনার অতীত। মাথায় একটি স্পেসিফিক ছাঁটের চুল কাটতে বলা, সন্ধে ৬টার মধ্যে হস্টেলে ঢোকার ফরমান, ক্রমাগত সিনিয়রদের ফাইফরমাশ খাটা, সারা রাত জাগিয়ে রেখে ‘ইন্ট্রো’ (শুনছি ‘আসল ইন্ট্রো’ নেওয়াই হয়নি এখনও ) নেওয়া। ওই তিন রাত ধরে এগুলো আমার সঙ্গে চলছে এবং আমিও ভয় পেয়েই রয়েছি।’’
প্রথম বর্ষের পড়ুয়ার আরও সংযোজন, ‘‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় আমার কাছে সব থেকে লড়াকু একটি বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে প্রতিটি ছাত্রছাত্রী অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে জানে, এরা প্রতিবাদের পথ দেখায়।’’ তবে এরপরেই তিনি লিখেছেন, সমাজের বাকি ক্ষেত্রে দুর্বলের উপর সবলের ক্ষমতা প্রদর্শনের যে ধারা, এখানে তার কোনও ব্যতিক্রম তিনি দেখতে পাননি। একইরকম শোষণ দেখছেন হোস্টেলের সিনিয়রদের (ইউনিয়ন নেতাদের মদতপুষ্ট) মধ্যে।
অর্পনের এই পোস্ট দেখা মাত্রই শুরু হয়েছে বিস্তর জল্পনা। তবে কি স্বপ্নদীপের মামা অরূপ কুণ্ডুর আশঙ্কাই ঠিক? ছাদ থেকে পড়ে নয়, বরং র্যাগিং নামক নোংরামোর শিকার হয়েছে প্রথম বর্ষের ওই পড়ুয়া? পুলিশের বয়ান বলছে, বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন হস্টেলের ‘এ’ ব্লকের তিন তলার বারান্দা থেকে ‘কোনও ভাবে’ পড়ে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে স্বপ্নদীপের। মৃত্যুর কারণ নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। ইতিমধ্যেই আত্মহত্যার তত্বকে খারিজ করে দিয়েছে স্বপ্নদীপের পড়ুয়া। তাঁর মা জানিয়েছেন, বুধবার রাতে মাকে ফোন করেছিলেন স্বপ্নদীপ। আত্মহত্যার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি তাঁর কথায়।
উল্টে সে জানায়, সে ভালো নেই। তাঁর খুব ভয় করছে। মা যেন শীঘ্রই তাঁর কাছে আসেন। তাঁর অনেক কথা বলার আছে মাকে। যদিও শেষ ফোন কেটে যাওয়ার পর আর তার গলা শোনা যায়নি। যা বলার ছিল সেটাও বলে যেতে পারেনি প্রথম বর্ষের পড়ুয়া স্বপ্নদীপ। এমতাবস্থায় সহপাঠী অর্পণের কথায় ‘র্যাগিং’-এর তত্ত্বই আরও বেশি জোরালো হচ্ছে। কেউ কেউ তো বিষয়টি আরো তলিয়ে দেখতে পরামর্শ দিচ্ছেন। মা-কে কী এমন বলতে চেয়েছিলেন স্বপ্নদীপ যে তাকে মৃত্যুর মুখে পড়তে হল? তবে কি এর পেছনে রয়েছে আরও গভীর কোন ষড়যন্ত্র?
এইদিন নিজের ফেসবুক ওয়ালে অর্পন লিখেছেন, ‘‘যাদবপুরের মেন হস্টেল নিয়ে আমি অনেক গল্প শুনেছি। বন্যার্তদের সাহায্যের গল্প, কোয়ারেন্টাইনের সময় অসহায় মানুষের পাশে থাকার গল্প। যাদবপুর থানার নানা দাদাগিরির বিরুদ্ধে সারা দিন সারা রাতের ঘেরাওয়ের গল্প। আমি বিশ্বাস করি মেন হস্টেলের বেশির ভাগ দাদাই এই লড়াকু ঐতিহ্য বহন করেন। কিন্তু কয়েক জনের জন্য আমি আমার সহপাঠীকে হারালাম।’’
সিনিয়র দাদাদের কাছে তার কাতর আর্জি, ‘‘অনুরোধ করব, দু-চারটি ভোটের জন্য ইউনিয়ন লিডারশিপ এই ক্ষমতাবানদের বাঁচিয়ে রাখার যে আপস করে, তারা যেন সেই পথ থেকে সরে আসে। না হলে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কোনও তফাত হয় না। তারাও ভোটব্যাঙ্ক বাঁচাতে অন্যায়কে বকলমে সমর্থন করে। আর এখানেও দুটো ‘ভোট ঘুরে যাবে’ বলে কিছু ক্ষমতা-ধর্ষকামীকে লালন করা হচ্ছে। আজ অবধী ইউনিয়ন থেকে কোনো প্রচার দেখলাম না, বরং এমন ঘটনা শুনেছি বড় মাঠে র্যাগ দেওয়ার পর ইউনিয়ন দাদারা খাপের মতো করে আপোষ করে নিতে বলেছে।”