রাজা সাহা :-পরদিন বেলা করে হোটেল ছেড়ে পৌছে গেলাম আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আয়ার্স । দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণপূর্ব উপকূলে অ্যাটলান্টিক মহাসাগরে এসে মিশেছে উরুগুয়ে ও পারানা নামের দুই নদী ।‘রিও দ্য লা প্লাটা’ নামে পরিচিত এই দুই নদীর মিলনস্থল বা মোহনার পশ্চিমকূলে অবস্থিত ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত আর্জেন্টিনার রাজধানী ও সর্ববৃহৎ শহর বুয়েনস আয়ার্স । বিগত দুই শতক ধরে পৃথিবীর বিশেষত ইউরোপের বহু দেশ থেকে এই শহরে এসেছে বহু জাতি, বহু ভাষাভাষী এবং বহু ধর্মবিশ্বাসী অসংখ্য মানুষ আর তাই এই শহরের সংস্কৃতি বহুবিচিত্র । প্রথমেই চলে এলাম রিও দ্য লা প্লাটা নদীর পশ্চিম পাড়ে ‘পালেরমো’ নামের অভিজাত এলাকায় । ‘কোর্তাজার স্কোয়ার’-এর পাশ দিয়ে ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম ‘বুয়েনস আয়ার্স বোটানিক্যাল গার্ডেন’, ‘ল্যাটিন আমেরিকান আর্ট মিউজিয়াম’, ‘গালিলিও প্ল্যানেটারিয়াম’ । চলে এলাম নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা নতুন বন্দর এলাকা ‘পুয়ের্তো মাদেরো’ এলাকায় ।
এবার চলে এলাম এই শহরের মূল আকর্ষণ এবং অবশ্য দ্রষ্টব্য ‘মে স্কোয়ার’-এর সামনে । ১৮১০ খৃষ্টাব্দের ‘মে রিভলিউসন’ থেকে ১৮১৬ খৃষ্টাব্দে ঔপনিবেশিক স্পেনীয়দের হাত থেকে স্বাধীনতা প্রাপ্তি উৎযাপন সহ সমস্ত রাজনৈতিক ও বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের মূল কেন্দ্র এই স্কোয়ার । ১৮১১ সালে সংযোজিত হয় ‘মে পিরামিড’ ।
এই শহরের চারপাশে অসংখ্য উল্লেখনীয় দ্রষ্টব্য । ঔপনিবেশিক আমলে নগর নিগম ও রাজপ্রতিনিধির সরকারী ভবন ‘ক্যাবিলডো’ নামের সুন্দর এই প্রাসাদ বর্তমানে এক মিউজিয়াম । চকের পূর্ব প্রান্তে আর এক বিরাট অট্টালিকা ‘কাসা রোসাদা’ বা ‘পিঙ্ক হাউস’ – আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টের বাসগৃহ ও সরকারী কার্যালয় । বিশেষ অনুমতি ছাড়া এখানে ঢোকা নিষেধ । অট্টালিকায় কলম্বাসের নামে স্মৃতিস্তম্ভ, বিগত সমস্ত প্রেসিডেন্টদের আবক্ষ মূর্তি সম্বলিত কক্ষ আছে । পৃথিবী বিখ্যাত ‘বোকা জুনিয়ার’ ফুটবল ক্লাবের হোম গ্রাউণ্ড ‘লা বোম্বোনেরা’ স্টেডিয়াম দেখতে চলে এলাম শহরের উপকন্ঠে । ফুটবলের রাজপুত্র মারাদোনার স্মৃতি বিজড়িত এই অলীক স্টেডিয়ামে বসে ‘বোকা জুনিয়ার’ বনাম ‘রিভার প্লেট’ নামের দুই দলের খেলা দেখা যে কোনও ফুটবল প্রেমীর এক স্বপ্ন ।
‘প্লাজা দ্য মেয়ো’ বা মে স্কোয়ারের আর এক দ্রষ্টব্য ‘মেট্রোপলিটন ক্যাথিড্রাল’-এর দরজায় চলে এলাম – দর্শনী ৫০ পেসো । আর্জেন্টিনা, পেরু ও চিলিকে স্পেনীয় ঔপনিবেশিক শাসন থেকে সফলভাবে মুক্ত করেছিলেন যে জেনারেল সেই ‘হোসে দ্য সান মার্টিন’ এর দেহাবশেষ ১৮৮০ সালে ফ্রান্স থেকে এনে এই গির্জায় রক্ষিত আছে কালো রংয়ের এক ‘সারকোফেগাস’-এ । প্রহরায় তিন নারীমূর্তি – যেন এই তিন স্বাধীনতা প্রাপ্ত দেশের প্রতিভূ । গথিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত এই ক্যাথিড্রালের মেঝের মোজাইক ভেনেশিয়ান শৈলীতে নির্মিত ।
বুয়েনস আয়ার্স এসেছি আর মারাদোনার বাড়ি দেখব না – সেটা আবার হয় নাকি ? প্রায় ৩০ কিমি ট্যাক্সি চেপে চলে এলাম শহরের উপকণ্ঠে অভিজাত এলাকা ‘Bella Vista’ – পথচারীকে জিজ্ঞাসা করে চলে এলাম ফুটবলের যুবরাজের বাড়ির সামনে । ভেতরে ঢোকা বারণ । বাড়ি দেখে জীবন সার্থক করে ফিরে এলাম হোটেলে ।
শহরের ‘সান টেলমো’ এলাকার ‘লা ভেনতানা’ হলে চলে এলাম ট্যাঙ্গো শো দেখতে- সঙ্গে ওয়াইন সহযোগে থ্রি কোর্স ডিনার । আমাদের অনুষ্ঠানের নাম ‘Tango Porteno’ -৩০ জন কলাকুশলী, ১২ জন বাদকের এক অর্কেস্ট্রা, ৮ জোড়া পেশাদার নর্তক-নর্তকী আর দুজন গায়ক গায়িকা সংবলিত একটা দল – পরিবেশন করলো ট্যাঙ্গো নাচের এক অনন্যসাধারণ আধুনিক ও সঙ্গীতময় অনুষ্ঠান । সুরের মূর্ছনায় ভেসে প্রায় তিন ঘণ্টা ব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে আমরা বাকরুদ্ধ । হোটেলে ফিরে এসেও কানে ভাসছিল স্প্যানিশ সুর ।
এবার দেখতে চলে এলাম আর্জেন্টিনার ‘মিশিওনেস’ ও ব্রাজিলের ‘পারানা’ এই দুই প্রদেশের সীমানায় বয়ে চলা ‘ইগুয়াজু’ নদীতে সৃষ্ট প্রায় তিন কিমি চওড়া সারা পৃথিবীর প্রসস্থতম ‘ইগুয়াজু’ জলপ্রপাত । জলপ্রপাত নদীকে ভাগ করেছে আপার ও লোয়ার দুই ভাগে । ‘অ্যারোলিনিয়াস আর্জেন্টিনাস’-র বিমানে চেপে আর্জেন্টিনার ‘ক্যাটারাটাস দেল ইগুয়াজু’ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমে পরলাম । ব্রাজিলের ‘ফজ দো ইগুয়াজু’ এই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও এই শহরের খুব কাছে ।
আর্জেন্টিনার সীমানা পার হয়ে চলে এলাম ব্রাজিলীয় প্রান্তে । কিংবদন্তি – ‘নাইপি’ নামের এক সুন্দরী কন্যার রূপে আকৃষ্ট এক দেবতা সেই কন্যাকে বিয়ে করতে এসে দেখতে পান সেই কন্যা প্রেমাস্পদ ‘তারোবো’কে নিয়ে এই নদীপথে নৌকা করে পলায়ন রত । দেবতার ক্রোধ গিয়ে পরে নদীর ওপর – জলপ্রপাত সৃষ্টি করে নদীকে করেন দ্বিখণ্ডিত ও প্রেমিক যুগলকে অভিশাপ দেন চিরন্তন পতনের । ‘পারানা’ এবং ‘ইগুয়াজু’ নদীর সঙ্গমস্থলের ২৩ কিমি উত্তরে ইগুয়াজু নদী যেখানে গড়িয়ে পরেছে ব্রাজিলের পারানা মালভূমিতে সেখানেই অবস্থান এই বিখ্যাত জলপ্রপাতের ।
ব্রাজিল প্রান্তে নদীর গিরিখাদ ধরে হাঁটা পথ ধরে চলতে চলতে দেখতে পেলাম বিভিন্ন প্রাকৃতিক অন্তরায় এই জলপ্রপাতকে ভাগ করেছে অগুনতি ছোট ছোট জলপ্রপাত ও ঝর্ণায় – কোনটা ২০০ ফুট কোনটা আবার ৩০০ ফুট চওড়া । বাধা অতিক্রম করে জলধারা এসে পড়েছে ‘ডেভিলস থ্রোট’ নামে এক দীর্ঘ কিন্ত সংকীর্ণ খাদে । হাঁটাপথ ধরে চলে এলাম ডেভিলস থ্রোটের খুব কাছাকাছি । অসাধারণ সুন্দর এক রামধনু দেখলাম । জলের ছিটের হাত থেকে ক্যামেরা রক্ষা করা গেলেও মাথা রক্ষা করা অসম্ভব । অপূর্ব সুন্দর এই জলপ্রপাতকে প্রাণ ভরে উপভোগ করে ফিরে এলাম রাতের আশ্রয়স্থল কেতাদুরস্ত হোটেল ‘Viale Cataratas’.
To be continued