একসময় গমের জন্য ভারতকে “ভিখারিদের দেশ” বলেছিল আমেরিকা! আজ তা পেতে করছে কাকুতিমিনতি

বাংলা হান্ট ডেস্ক: সম্প্রতি ভারত সরকারের গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের জেরে সমালোচনা হচ্ছে সর্বত্র। এমনকি, সরকারের এই সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমেরিকাসহ বিশ্বের একাধিক দেশ। তবে আমাদের দেশে গম ও আটার ক্রমবর্ধমান মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এদিকে, গম রপ্তানির এই নিষেধাজ্ঞায় চরম ক্ষুব্ধ হয়েছে আমেরিকা। এমনকি, জার্মানিতে অনুষ্ঠিত জি-৭ বৈঠকে, মার্কিন কৃষি সচিব টম ভিলস্যাক এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে এটিকে “ভুল সময়ে ভুল পদক্ষেপ” বলে অভিহিত করেছেন। পাশাপাশি, তিনি আরও বলেছেন যে, “আমাদের এমন একটি বাজার দরকার যা অভাবী মানুষের কাছে পণ্য সরবরাহ করতে সহায়তা করতে পারে।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত ১৩ মে গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছিল ভারত। এদিকে, ভারত এমন এক সময়ে এই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী গমের সরবরাহ ব্যাহত হয়েছে। পাশাপাশি, ভারত গম রপ্তানির ক্ষেত্রেও বিশ্বে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এমনকি, চিনের পর ভারতেই সবচেয়ে বেশি গমের উৎপাদন হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২১-২২ সালে ভারতে ১,১১৩ লক্ষ টন গম উৎপাদিত হয়েছে।

এমতাবস্থায়, আমেরিকা আজ ভারতের গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে বিরক্তি প্রকাশ করেছে। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন আমেরিকা গমের জন্য ভারতকে হুমকি পর্যন্ত দিত। মূলত, ভারতকে তখন গমের জন্য আমেরিকার উপর নির্ভর করতে হত। মূলত, ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের সময় আমেরিকা ভারতকে গম না দেওয়ার হুমকি দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, আমেরিকা একসময় ভারতকে “ভিক্ষুকের দেশ” বলেও অভিহিত করে।

খাদ্যের প্রয়োজনীয়তার জন্য আমেরিকার সাথে চুক্তি:
১৯৬৪ সালের ২৭ মে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর লাল বাহাদুর শাস্ত্রী প্রধানমন্ত্রী হন। এদিকে, ১৯৬৫ সালে, যখন পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধ চলছিল, লাল বাহাদুর শাস্ত্রী সেই সময়ে “জয় জওয়ান, জয় কিষাণ” স্লোগান দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে রামচন্দ্র গুহের “ইন্ডিয়া আফটার নেহেরু” বইতে লেখা আছে যে, স্বাধীনতার পর বর্ষা বিঘ্নিত হওয়ায় ভারতে খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমে গিয়েছিল।

এমনকি, ভারত ১৯৬৪ এবং ১৯৬৫ সালে খরার সম্মুখীন হয়। আর স্বাভাবিকভাবেই এতে চিন্তিত হয়ে পড়েন শাস্ত্রী। পাশাপাশি, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি প্রথমেই কৃষিক্ষেত্রে বাজেট বাড়ান। এছাড়াও, উন্নত জাতের বীজ উৎপাদনের জন্য ভারতীয় বীজ নিগমের প্রতিষ্ঠা করা হয়।

তা সত্ত্বেও যতক্ষণ না পর্যন্ত দেশ খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে সক্ষম হচ্ছে ততক্ষণ খাদ্য নিরাপত্তার নিশ্চয়তা প্রয়োজন ছিল। এ জন্য তৎকালীন খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রকের দায়িত্ব পেয়ে সুব্রহ্মণ্যম আমেরিকা সফর করেন। পাশাপাশি, তিনি মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনের সঙ্গেও দেখা করেন। ওই বৈঠকে আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। এই চুক্তির আওতায় আমেরিকা ভারতকে দীর্ঘমেয়াদে এবং কম সুদে অনেক ঋণ দেয় এবং গম সরবরাহে সম্মত হয়। আর এভাবেই আমেরিকা থেকে গম এনে খাদ্য সমস্যা থেকে তাৎক্ষণিক মুক্তি পায় ভারত।

হুমকি দেয় আমেরিকা:
১৯৬২ সালে, ভারত চিনের সাথে যুদ্ধ করে। এমতাবস্থায়, পাকিস্তান ভারতকে দুর্বল মনে করে ১৯৬৫ সালের ৫ আগস্ট প্রায় ৩০ হাজার পাকিস্তানি সেনা নিয়ন্ত্রণ রেখা অতিক্রম করে কাশ্মীরে প্রবেশ করে। এটি পাকিস্তানের জন্য একটি বড় ভুল প্রমাণিত হয়েছিল। পাশাপাশি, ভারতীয় সেনা এর যোগ্য জবাবও দেয়। এই আবহেই ভারতকে হুমকি দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন। তিনি জানান, যুদ্ধ বন্ধ না হলে গম সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হবে। এদিকে, শাস্ত্রী অত্যন্ত আত্মমর্যাদাশীল ছিলেন। যার ফলে তিনি আমেরিকার হুমকি প্রত্যাখ্যানও করেন।

১৯৬৫ সালে, দশেরার দিনে রামলীলা ময়দানে লালবাহাদুর শাস্ত্রী একটি সমাবেশ করেছিলেন। ওই সমাবেশে “জয় জওয়ান-জয় কিষাণ” স্লোগান দেওয়া হয়। এমনকি, ওই সমাবেশে শাস্ত্রী দেশবাসীর কাছে সপ্তাহে একবেলার খাবার না খাওয়ার আবেদন করেন। এছাড়া, তিনি নিজেও একবেলার খাওয়া ছেড়ে দেন। শাস্ত্রীর আবেদনে দেশের মানুষও এই কাজ করেন।

আমেরিকা ভারতকে “ভিক্ষুকের দেশ” বলেছিল:
তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাসখন্দে প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রী মারা যান। তাঁর মৃত্যুর পর ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী হন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর, ইন্দিরা গান্ধী ১৯৬৬ সালের মার্চ মাসে তাঁর প্রথম বিদেশ সফরে যান। তিনি প্যারিস এবং লন্ডনে থাকলেও, তাঁর ভ্রমণের মূল উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকা। সেইসময়ে ভারত তার খাদ্যের প্রয়োজনে আমেরিকার উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিল।

এই প্রসঙ্গে “নেহেরু আফটার ইন্ডিয়া” বই অনুসারে জানা যায় যে, আলাবামার একটি সংবাদপত্র ইন্দিরা গান্ধীর এই সফরের শিরোনাম লিখেছিল যে, “ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী খাদ্যশস্য ভিক্ষা করতে আমেরিকায় আসছেন।” যদিও, ইন্দিরা গান্ধী তাঁর ব্যবহার ও আচরণে আমেরিকানদের মুগ্ধ করেছিলেন। এমনকি, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসনও তাঁকে দেখে অত্যন্ত মুগ্ধ হন।

কিন্তু ইন্দিরা গান্ধী ভারতে ফিরে এলে জনসন ভারতের দাবি পূরণে শর্ত দেন। মূলত, ভারত এক বছরের জন্য এককালীন খাদ্য সহায়তার দাবি করেছিল, কিন্তু জনসন তা প্রতি মাসের ভিত্তিতে শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। জনসনের মতে, ভারতীয়রা তখনও বিশ্বের পথ সম্পর্কে সচেতন ছিল না। এমনকি, তারা খুব কঠোর ছিল এবং তাদের আস্ফালন ভাঙারও প্রয়োজন ছিল। জনসন এমনও বলেছিলেন যে, আমেরিকা থেকে হাজার হাজার শ্রমিককে ভারতে পাঠানো উচিত তাঁদের কৃষিকাজ শেখানোর জন্য।

কিন্তু ভারতে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জনসনের এই সিদ্ধান্তকে “নিষ্ঠুর সিদ্ধান্ত” বলে অভিহিত করেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অভিমত ছিল যে, আমেরিকানরা এশিয়ায় চাষাবাদ পদ্ধতি সম্পর্কে কিছুই জানে না।এদিকে, ১৯৬৫ এবং ১৯৬৬ সালে, ভারত সরকারি ঋণ প্রকল্পের অধীনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৫ মিলিয়ন টন গম আমদানি করে। এটি PL480 নামে পরিচিত। এই শস্য দিয়ে প্রায় ৪ কোটি ভারতীয়দের ক্ষুধা দূর করা হয়। এমতাবস্থায়, মার্কিন কৃষি বিভাগ এক প্রতিবেদনে ভারতের উদ্দেশ্য ব্যঙ্গ করে লেখে, “হিন্দুস্তান ভিক্ষুক ও নিঃস্বের দেশ।”

এদিকে, ১৯৬৬ সালে, বর্ষার জেরে ভারত আবার দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। যার ফলে, ফের PL480-এর অধীনে, আমেরিকার কাছে খাদ্যশস্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়।

এখন ভারতের কাছে আবেদন!
রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে গমের ঘাটতি ছিল, যা ভারত পূরণ করছে। এমতাবস্থায়, ভারতের গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে, জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা থমাস-গ্রিনফিল্ড বলেছেন যে, এটি খাদ্য ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।

Wheat 1500

পাশাপাশি, তিনি আরও বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করে যে ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করবে। ভারতের এই সিদ্ধান্তে বর্তমান বিশ্ব খাদ্য সঙ্কট আরও খারাপ হবে। এমনকি, রপ্তানির উপর কোনো বিধিনিষেধ খাদ্য ঘাটতিকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে বলেও মনে করেছেন তিনি।


Sayak Panda
Sayak Panda

সায়ক পন্ডা, মেদিনীপুর কলেজ (অটোনমাস) থেকে মাস কমিউনিকেশন এবং সাংবাদিকতার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করার পর শুরু নিয়মিত লেখালেখি। ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা হান্ট-এর কনটেন্ট রাইটার হিসেবে নিযুক্ত।

সম্পর্কিত খবর