বাংলা হান্ট ডেস্কঃ যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণত অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয় গুলি বোমা বন্দুক। কিন্তু গত দেড় বছরে পাল্টে গিয়েছে যুদ্ধের ধরন। অস্ত্র যখন ভাইরাস, তখন যোদ্ধা হয়ে উঠেছেন সাদা অ্যাপ্রোন পরা স্টেথোধারাইরাই। কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গত দেড় বছর ধরে চলছে তাদের প্রাণপণ লড়াই। গ্রাম থেকে শহর চিত্রটা সব জায়গাতেই প্রায় সমান। রোগীর সংখ্যা অনুযায়ী চিকিৎসকের সংখ্যা এতই সীমিত যে তাহলে উঠেছে রীতিমতো আতঙ্কজনক। কিন্তু থামলে তো চলবে না। এই মুহূর্তে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন সকলেই। কোভিড আক্রান্ত হয়ে কখনো কখনো এই ফ্রন্টলাইন যোদ্ধারাই ঢলে পরছেন মৃত্যুর কোলে। আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গেই গত ২৪ ঘন্টায় এই মারুন যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন ৪ জন চিকিৎসক। শুক্রবার করোনা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ডিন তথা স্বনামধন্য প্যাথলজিস্ট সুবীর দত্তর। শুক্রবার ঢাকুরিয়া হাসপাতালে সকাল দশটা নাগাদ মৃত্যু হয় তার। বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। কয়েক বছর আগেই চিকিৎসা জ্যোতি সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন তিনি। মহামারীর কবলে পরে মৃত্যু হয়েছে বারাসত হাসপাতালে কর্মরত উৎপল সেনগুপ্ত এবং প্রখ্যাত শল্যচিকিৎসক সতীশ ঘাটারও।
তবে সবচেয়ে আশঙ্কাজনক ঘটনা ঘটেছে ৩৭ বছরের সন্দ্বীপান মন্ডলের ক্ষেত্রে। কোন কো-মর্বিডিটি না থাকা সত্ত্বেও করোনার সঙ্গে লড়াই করতে করতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন এই তরুণ চিকিৎসক। স্বাভাবিকভাবেই শোকে মুহ্যমান সকলেই। মুর্শিদাবাদ মেডিকেল কলেজের সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। তার উপর সবচেয়ে দুঃখজনক সংবাদটি হলো তার স্ত্রী এখন অন্তঃসত্ত্বা। ওয়েস্টবেঙ্গল ডক্টরস ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক কৌশিক চাকির কথায়, “সন্তান জন্মের পর তার বাবাকে দেখতে পাবেনা। রাজ্য স্বাস্থ্য দপ্তরের কাছে আমার অনুরোধ এই পরিবারটির দায়িত্ব নিন।”
একদিকে যেমন ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের এই অসহায় মৃত্যুতে শোকাহত সকলে। তেমনি অন্যদিকে বাড়ছে আরেকটি আশঙ্কাও। রোগীর তুলনায় ক্রমশ কমে যাচ্ছে চিকিৎসকের পরিমাণ। দেশে নিরিখে সংখ্যাটা এই মুহূর্তে ভীষণই সংকটজনক। সারাদেশে এই মুহূর্তে ১১,০৮২ জন রোগীর দায়িত্বে রয়েছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। রাজ্যে এই সংখ্যাটা কিছুটা কম হলেও আশঙ্কার মেঘ রয়েছে যথেষ্ট। আমাদের রাজ্যে বর্তমানে ১৩৩০ জন রোগীর পিছনে রয়েছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। অন্যদিকে ফ্রন্টলাইন যোদ্ধাদের এই অসহায় মৃত্যু নিশ্চিত ভাবেই শোকাহত করছে সকলকে। ডঃ কৌশিক চাকি বলেন, “পরিস্থিতি ভয়াবহ। গত পাঁচ-সাত বছরে রাজ্যে ডাক্তারি আসন বেড়েছে প্রায় তিন গুণ। আগের চেয়ে এখন ঢের বেড়েছে প্রতি বছর ডাক্তার তৈরির সংখ্যা। তেমন রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ফি দিন বিপুল সংখ্যক রোগী আসেন। একেক জন চিকিৎসককে দীর্ঘ সময় ধরে, রোগী দেখে যেতে হয়।”
একই বক্তব্য প্রখ্যাত চিকিৎসক ডক্টর অরিন্দম বিশ্বাসেরও। তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে রোগীর নিরিখে রাজ্যের চিকিৎসকের সংখ্যা যথেষ্ট অপ্রতুল। এরই মধ্যে গতকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন চারজন বিশিষ্ট চিকিৎসক যা খুবই দুঃখজনক। চিকিৎসকদের ক্ষেত্রেও পরিশ্রম তা মারাত্মক হয়ে উঠছে। এর ওপর পরামর্শ দিয়ে অনেকেই সাহায্য করতে হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমেও। যা মানসিকভাবেও আমাদের যথেষ্ট বিধ্বস্ত করে। তবে কিছু তো করার নেই এই মুহূর্তে সামনে লড়াই। আর তা লড়ে যেতে হবে। আমাদের এই রাজ্যে অক্সিজেনের সংকট এখনো তেমন ঘটেনি। তবে আগামী দিনে রোগীর সংখ্যা আরো বাড়লে ভেন্টিলেটরের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সমস্যা তৈরি হতে পারে। তাই সকলকেই বলবো সামান্যতম উপসর্গ থাকলেও টেস্ট করান। সেক্ষেত্রে চিকিৎসকদের কাজটা কিছুটা সহজ হয়ে ওঠে।”
একইসঙ্গে গ্রামগঞ্জে করোনা পরীক্ষার পরিমাণ বাড়ানোর জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করেন তিনি। চিকিৎসকরা কঠিন লড়াই লড়তে প্রস্তুত। তবে যেভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে কোভিড। তা আশঙ্কার পরিস্থিতি তৈরি করেছে তাদের জন্যও।