বাংলা হান্ট ডেস্ক: ইতিমধ্যেই মার্কিন গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের (Hindenburg Research) নেতিবাচক রিপোর্টের ফলে আদানি গ্রূপ (Adani Group) বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি, আদানি গ্রূপের অন্তর্ভুক্ত কোম্পানিগুলির শেয়ারের দামেও ব্যাপক পতন ঘটায় গৌতম আদানির (Gautam Adani) মোট সম্পদের পরিমান বিপুলভাবে হ্রাস পায়। যার কারণে বিশ্বের শীর্ষ-২০ ধনীর তালিকা থেকেও ছিটকে যান তিনি। মূলত, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্ট রীতিমতো কাঁপিয়ে দিয়েছে আদানি সাম্রাজ্যের ভিতকে।
যদিও, আদানি গ্রূপের তরফে হিন্ডেনবার্গের করা অভিযোগগুলিকে অস্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু তা সত্বেও সংস্থার শেয়ারের দাম কমেছে প্রায় ৬৫ শতাংশ। তবে, ধারাবাহিকভাবে এক সপ্তাহ শেয়ারের দরপতনের পর আবারও আদানি গ্রুপের শেয়ারে সামান্য বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়েছে। এদিকে, স্টক মার্কেটের ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যাবে যে, শিল্পপতি ধীরুভাই আম্বানিও (Dhirubhai Ambani) প্রায় চার দশক আগে ঠিক এইরকম এক ঘটনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তবে, আম্বানি নিজের মত করে বিষয়টি মিটিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, আজও ধীরুভাই আম্বানির সেই সাহসী পদক্ষেপের কথা মনে রেখেছেন সবাই।
মূলত, ১৯৮২ সালে ধীরুভাই আম্বানির সাথে আদানির মতো ঘটনাই ঘটেছিল। যদিও, সেইমুহূর্তে ধীরুভাই শেয়ার বাজারের কিছু বড় দালালকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাঁর কোম্পানি রিলায়েন্সের সাথে টক্কর নেওয়া কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। এমনকি, ধীরুভাইয়ের ওই সাহসী পদক্ষেপের কারণে ১৯৮২ সালের ১৮ মার্চ তারিখে মুম্বাই স্টক এক্সচেঞ্জে শোরগোল পড়ে যায়।
ধীরুভাইয়ের সাহসিকতাকে স্যালুট: ১৯৭৭ সালে, ধীরুভাই আম্বানি তাঁর সংস্থা রিলায়েন্সকে শেয়ার বাজারে তালিকাভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময়ে, রিলায়েন্স শেয়ার প্রতি ১০ টাকা হারে প্রায় ২৮ লক্ষ ইক্যুইটি শেয়ার ইস্যু করে। এদিকে, ইনিশিয়াল পাবলিক অফারিংয়ের (IPO) মাধ্যমে শেয়ার বিক্রি শুরু হয়। এক বছরেরও কম সময়ে রিলায়েন্স কোম্পানির শেয়ারের দাম ৫ গুণ বেড়ে ৫০ টাকা হয়ে গিয়েছিল। তারপর ১৯৮০ সালে একটি শেয়ারের দাম হয় ১০৪ টাকা এবং ১৯৮২ সালে তা ১৮ গুণ বেড়ে ১৮৬ টাকায় পৌঁছে যায়। ঠিক একইভাবে আদানি গ্রুপের শেয়ারও গতি লাভ করেছিল। এরপর ধীরুভাই ডিবেঞ্চারসের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনা করেন। ডিবেঞ্চারস হল কোম্পানিগুলির ঋণের মাধ্যমে মূলধন সংগ্রহের একটি উপায়।
কিন্তু তখনই কলকাতায় বসে থাকা শেয়ার বাজারের কিছু দালাল রিলায়েন্সের শেয়ারের দরপতনের সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য একসাথে বড় পরিসরে শেয়ার বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি, দালালরা আশা করেছিল যে কোনো বড় বিনিয়োগকারী রিলায়েন্সের শেয়ার কিনবে না। এদিকে, সেই সময়ে কোম্পানির নিজস্ব শেয়ার কেনা যাবে না এমনও নিয়ম ছিল। এইভাবে, দালালরা ধীরুভাই আম্বানির বিরুদ্ধে রীতিমতো ষড়যন্ত্র করে ফেলেন।
তখনও ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল শর্ট সেলিং: এদিকে, রিলায়েন্সের শেয়ারের দাম কমাতে দালালরা “শর্ট সেলিং” করেছিল। পাশাপাশি, দালালদের পরিকল্পনা ছিল ব্রোকরেজ থেকে ধার করা শেয়ার তারা বাজার থেকে কম দামে কিনে ফেরত দেবে এবং বিপুল মুনাফা করবে। এমনকি, মাত্র আধ ঘণ্টায় শর্ট সেলিংয়ের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ শেয়ার বিক্রি করে দালালরা। এদিকে, একসঙ্গে এতগুলি শেয়ার বিক্রির কারণে রিলায়েন্সের প্রতিটি শেয়ারের দাম ১৩১ থেকে ১২১ টাকায় নেমে আসে। মূলত, কলকাতায় বসে থাকা দালালরা “শর্ট সেলিং”-এর মাধ্যমে রিলায়েন্সের শেয়ারের দাম কমিয়ে মুনাফা অর্জন করতে চেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে, আদানি গ্রূপের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তোলা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ সংস্থাটিও “শর্ট সেলিং”-এর মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে।
এদিকে, দালালদের এই পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে পেরেই ধীরুভাই আম্বানি তাঁর কিছু দালালকে রিলায়েন্স টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কিনতে রাজি করান। এর পরেই আসল খেলা শুরু হয়েছিল। একদিকে কলকাতায় বসে দালালরা মুম্বাই স্টক মার্কেটে রিলায়েন্সের শেয়ার বিক্রি করছিল, অন্যদিকে আম্বানির অপারেটররা কিনছিল। যার কারণে শেয়ারের দাম কমার পরিবর্তে উপরে উঠতে থাকে এবং তারপর শেয়ারের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১২৫ টাকায়।
বিপদে পড়েন ষড়যন্ত্রকারীরা: ওই সময়ে রিলায়েন্স টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের মোট ১১ লক্ষ শেয়ার বিক্রি হয়েছিল এবং এর মধ্যে ৮ লক্ষ ৫৭ হাজার শেয়ার কিনে নেয় আম্বানির দালালরা। অর্থাৎ কলকাতায় বসে থাকা দালালরা নিজেদের ফাঁদেই ধরা পড়ে যায়। ঠিক তার পরের শুক্রবার আম্বানির দালালরা কলকাতায় বসে থাকা দালালদের কাছে শেয়ার চাইতে থাকে। এদিকে, ফিউচার ট্রেডিংয়ের কারণে দালালদের শেয়ার ছিল না। এমনকি, যারা ১৩১ টাকায় শেয়ার বিক্রি করে তাদের অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। কারণ ততক্ষণে প্রকৃত শেয়ারের দাম অনেক বেশিতে পৌঁছে গিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে তারা যদি সময় চাইত, তাহলে দালালদের প্রতি শেয়ারে ৫০ টাকা দিতে হত।
কিন্তু ধীরুভাইয়ের দালালরা কলকাতার অপারেটরদের সময় দিতে রাজি হয়নি। এর পরে দালালরা একটি বড় ধাক্কা পেয়েছিল এবং তাদের উচ্চ মূল্যের বিনিময়ে রিলায়েন্স টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রিজের শেয়ার কিনতে এবং বিক্রি করতে হয়েছিল। এমনকি, সেইসময় বিষয়টি এতটাই বড় হয়ে গিয়েছিল যে, তিনদিনের জন্য স্টক মার্কেট বন্ধও রাখতে হয়েছিল। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকায়নি রিলায়েন্সের শেয়ার। এদিকে, ধীরুভাই আম্বানির এই পদক্ষেপে খুচরো বিনিয়োগকারীদের কোম্পানির প্রতি আরও আস্থা বেড়ে যায়। পাশাপাশি, ধীরুভাই আম্বানি হয়ে উঠেছিলেন শেয়ার বাজারের “মসীহা”।