বাংলা হান্ট ডেস্ক: সাধারণত কোনো ধনী ব্যক্তির প্রসঙ্গে আমরা প্রায়শই “মালদার” শব্দটির ব্যবহার করি। যেটির মাধ্যমে ওই ব্যক্তির সম্পদ এবং প্রতিপত্তির বিষয়টি ফুটিয়ে তোলা হয়। এমতাবস্থায়, বর্তমান প্রতিবেদনে আজ আমরা এমন একজন ধনবান ব্যক্তির প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করব যাঁর নামের সাথেই “মালদার” শব্দটি বসে গিয়েছে। মূলত, আমরা উত্তরাখণ্ডের প্রথম কোটিপতি হিসেবে পরিচিত দান সিংহ বিশত ওরফে দান সিং মালদারের কথা বলছি। যিনি কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে গড়ে তুলেছিলেন নিজের বিরাট সাম্রাজ্য।
এমনকি, তিনি একাধিক ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে সাফল্যের সাথে তাঁর ছাপ রেখেছিলেন। যে কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারও তাঁর প্রশংসা করে। কিন্তু এককালের এই বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক হয়েও ইতিহাসের পাতায় আজও দান সিংহ ব্রাত্য হিসাবেই থেকে গিয়েছেন। এমতাবস্থায়, উত্তরাখণ্ডের প্রথম বিলিয়নেয়ার তথা ভারতের টিম্বার কিং নামে পরিচিত এই দানশীল ব্যক্তির জীবনবৃত্তান্ত অবাক করবে সকলকেই।
দেব সিংহের ঘরে জন্ম নেন তিনি:
উত্তরাখণ্ডের ভারত ও নেপালের সীমান্তবর্তী স্থান ঝুলাঘাটে দেশ স্বাধীনের আগে দেব সিং বিশত নামে এক ব্যক্তি তাঁর ছোট একটি দোকানে ঘি বিক্রি করতেন। মূলত দেব সিংহের পূর্বপুরুষরা নেপালের বৈত্রি জেলার বাসিন্দা হলেও পরে তাঁরা পিথোরাগড়ের কভিতার গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। সেই থেকে দেব সিংয়ের পরিবার সেখানেই থাকতেন। এমতাবস্থায়, ১৯০৬ সালে জন্ম হয় দান সিংহ বিশতের।
অল্প বয়সে বড় স্বপ্ন দেখেছিলেন:
মাত্র ১২ বছর বয়সেই দান সিংহ কাঠের ব্যবসা করতেন এমন একজন ব্রিটিশ ব্যবসায়ীর সাথে বার্মা (বর্তমান মায়ানমারে) যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেখানে গিয়ে তিনি ব্যবসা সংক্রান্ত একাধিক জিনিস মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করেন এবং পরবর্তীকালে সাফল্যও পান। কাঠের ব্যবসায় অর্জিত দক্ষতা তাঁকে পরবর্তীকালে ভারতের “টিম্বার কিং” উপাধি এনে দেয়।
বাবার সাথে ঘি বিক্রি করতেন:
পাশাপাশি, বার্মা থেকে ফিরে তিনি তাঁর বাবার সাথে ঘি বিক্রির কাজও শুরু করেছিলেন। এদিকে, তিনি নিজে থেকেও একটা ব্যবসা শুরু করার কথা ভেবেছিলেন। এরই মধ্যে তাঁর বাবা বেরিনাগে একটি ব্রিটিশ কোম্পানির কাছ থেকে চা বাগান কিনেছিলেন। যদিও, সেই সময়ে চায়ের দুনিয়ায় চিনের একচ্ছত্র অধিকার ছিল।
চিনের কাছ থেকে শিখে চিনকেই হারিয়ে দেন:
এমতাবস্থায় চিনে চা তৈরিতে কি ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয় সে সম্পর্কে দান সিংহ প্রথমে তথ্য নেন। এই প্রক্রিয়াটি শেখার পর তিনি এর ভিত্তিতে নিজে চা উৎপাদন শুরু করেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, দান সিং চিনের কাছ থেকে শিখেই চায়ের ব্যবসায় চিনকে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছে দেন। একটা সময় ছিল যখন বেরিনাগের চায়ের স্বাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে বহুদূর পর্যন্ত।
৬ হাজার লোকের কর্মসংস্থান:
একাধিক ব্যবসায় সফল হতে শুরু করেন দান সিং বিশত। পাশাপাশি, চা ব্যবসায় সফল হওয়ার পর, তিনি ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান কর্পোরেশন লিমিটেড নামে একটি কোম্পানির কাছ থেকে মদ তৈরির কারখানা কিনে নেন। এমনকি, সেখানে তিনি তাঁর বাবা এবং নিজের জন্য একটি বাংলো, কর্মচারীদের জন্য অফিস এবং বাসস্থান তৈরি করেছিলেন। সেই সময় তিনি তাঁর ব্যবসার মাধ্যমে উত্তরাখন্ডের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য এলাকার প্রায় ৬,০০০ লোকের কর্মসংস্থান করেছিলেন।
জিম করবেটের সাথে বন্ধুত্ব:
এমতাবস্থায় তিনি ব্রিটিশদের সঙ্গেও বন্ধুত্ব করেছিলেন। তাঁর বন্ধুদের মধ্যে একটি বড় নাম ছিল জিম করবেট। যিনি সেই যুগের একজন বিখ্যাত লেখক এবং মহান শিকারীও বটে। মূলত, শিকারের কারণেই তাঁদের বন্ধুত্ব হয়েছিল।
রাজা গজেন্দ্র সিংহের সম্পত্তি ক্রয় করেন:
দান সিং ১৯৪৫ সালে মোরাদাবাদের রাজা গজেন্দ্র সিংয়ের বাজেয়াপ্ত সম্পত্তি ২,৩৫,০০০ টাকায় কিনে রীতিমতো হইচই ফেলে দেন। মূলত, রাজা গজেন্দ্র সিংয়ের ওপর ব্রিটিশ সরকারের এত বেশি ঋণ ছিল যে তাঁর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নিলাম করা হয়েছিল। এমতাবস্থায়, তিনি তা কিনে নেন।
বহু দান করেছেন তিনি:
এই মহান ব্যবসায়ী শুধু নিজের জন্যই সম্পদ বৃদ্ধি করেননি বরং, সামাজিক কাজেও যথেষ্ট দান করেছেন।তিনি জনকল্যাণের জন্য বহু বিদ্যালয়, হাসপাতাল ও খেলার মাঠ তৈরি করেছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে নৈনিতাল ওয়েলেসলি গার্লস স্কুলটি কিনেছিলেন এবং পরবর্তীকালে বাবার নাম দিয়ে তা চালু করেন। পাশাপাশি, কলেজ নির্মাণেও সহায়তা করেন দান সিংহ।
জানিয়ে রাখি, দান সিংহের জীবন নিয়ে একটি হিন্দি ছবিও তৈরি করে জগমানি পিকচার্স। “মালদার” নামের এই ছবিটি সারা ভারতে খুব ভালো ব্যবসা করেছিল। বিশেষ বিষয় হল দান সিংয়ের জীবনের উপর ভিত্তি করে এই ছবিটি তৈরি করতে দান সিংয়ের কাছ থেকে ৭০,০০০ টাকা ধার নেওয়া হয়। এমতাবস্থায়, ১৯৬৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর মালদার দান সিং বিশত এই পৃথিবীকে বিদায় জানান। এদিকে, কুমায়ুনের এই উদীয়মান ব্যবসায়ীর ব্যবসা শুধু দেশেই নয়, ব্রাজিলেও বিস্তৃত হচ্ছিল। এমনকি ব্রিটিশ সরকারও তাঁর ব্যবসায়িক দক্ষতাকে সম্মান জানায়। কিন্তু, তাঁর চলে যাওয়ার পরেই কার্যত ভেঙে পড়ে স্বপ্নের সাম্রাজ্য। শুধু তাই নয়, একসময়ে ভারতের অন্যতম ধনকুবের হওয়া সত্বেও আজও তিনি রয়েছেন আলোচনার বাইরে।