বাংলা হান্ট ডেস্ক: দীর্ঘ দুই সপ্তাহেরও বেশি ধরে চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের ভয়াবহ যুদ্ধ। রুশ সেনার ক্রমাগত হামলায় কার্যত ক্ষতবিক্ষত হয়ে উঠেছে ইউক্রেন। সমগ্র বিশ্বই এখন তাকিয়ে রয়েছে যুদ্ধের দিকে। এদিকে, এই যুদ্ধের আবহে সেখানে আটকে পড়েন কয়েক হাজার ভারতীয় পড়ুয়া। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে কার্যত দেশে ফেরার জন্য প্রহর গুণতে থাকেন তাঁরা। এমতাবস্থায়, এক বাঙালি সাহসিনীর ওপরেই আসে তাঁদের উদ্ধারের গুরুদায়িত্ব। যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন হাসিমুখেই!
২৭ তারিখ ভোররাতেই ফোন আসে একটি বেসরকারি সংস্থার (IndiGo) বিমানচালক (ফার্স্ট অফিসার) বছর চব্বিশের মহাশ্বেতা চক্রবর্তীর কাছে। আর তারপরেই মাত্র দু’ঘন্টার প্রস্তুতি নিয়ে প্রথমে নয়াদিল্লি হয়ে ইস্তানবুল এবং সেখান থেকে পোল্যান্ড পৌঁছে যান তিনি। ভয়াবহ যুদ্ধের মাঝে ইউক্রেনে আটকে পড়া ভারতীয় পড়ুয়াদের উদ্ধারে ভারত সরকারের “অপারেশন গঙ্গা”-র জন্য বেছে নেওয়া হয় মহাশ্বেতাকে!
ছোট থেকেই রোমাঞ্চ ভালোবাসেন তিনি। পাশাপাশি, ছিল ওড়ার স্বপ্নও। সেই স্বপ্ন পূরণ হলেও তিনি যে যুদ্ধের মঞ্চ থেকে উদ্ধারের ডাক পাবেন তা কখনই ভাবেননি মহাশ্বেতা। তাঁর আসল বাড়ি অশোকনগরে। মূলত পড়াশোনার জন্যই কলকাতায় আসেন তিনি। কলকাতার অক্সিলিয়াম কনভেন্ট স্কুল থেকে পড়াশোনার পর ইন্দিরা গান্ধী রাষ্ট্রীয় উড়ান অ্যাকাডেমি থেকে প্রশিক্ষণ পান মহাশ্বেতা। বর্তমানে অবশ্য নিউটাউনে থাকেন তিনি।
গত ৬ মার্চ শহরে ফিরে উদ্ধারকার্যের একের পর এক বাস্তব অভিজ্ঞতা রোমন্থন করতে থাকেন এই সাহসিনী। ইউক্রেন থেকে প্রায় ৮০০ পড়ুয়াকে নির্বিঘ্নে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন মহাশ্বেতা। আর এটাই বর্তমানে তাঁর পরম প্রাপ্তি। এই প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন যে, ‘‘আমি যে কত বার গিয়েছি এবং এসেছি, তা হিসেব করে দেখিনি। পড়ুয়াদের নিয়ে পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি কিংবা রোমানিয়া থেকে ইস্তানবুল, সেখান থেকে দিল্লি। আবার একই ভাবে পোল্যান্ড উড়ে যাওয়া।’’
পাশাপাশি, তিনি আরও বলেন, “এমনও দিন গেছে যেদিন ১৫-১৬ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করেছি শুধুমাত্র ব্ল্যাক কফি এবং বিস্কুট খেয়ে। কখনও কখনও নুডলস খেয়েও পেট ভরাতে হত। কাজের ব্যস্ততায় ঘুম হত না বলে খেতেও ইচ্ছে করত না।”
এদিকে, উদ্ধারকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রসঙ্গে মহাশ্বেতা জানিয়েছেন, “বাবা-মাকে বলেও সেদিন বাড়ি থেকে বেরোতে পারিনি। পরে জানতে পেরে মা বলেন, আমি কেন গেলাম সেখানে। কিন্তু পরে বুঝতে পারেন আমাকে ঠিক কোন কাজের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। এখন আমার কাজের জন্য ওঁরাও ভীষন গর্বিত।’’
তবে, শুধু “অপারেশন গঙ্গা”-ই নয়, এর আগেও করোনার মত ভয়াবহ মহামারীর সময়ে হংকং থেকে একাধিক বার অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, ওষুধ এবং টিকা নিয়ে দেশে এসেছেন মহাশ্বেতা। তবে যুদ্ধক্ষেত্রে এই প্রথমবার অবতীর্ণ হলেন তিনি। যদিও, মহতী এই কাজে সামিল হতে পেরে পরিতৃপ্তির হাসি ফুটেছে তাঁর মুখেও। দেশের পড়ুয়াদের সাক্ষাৎ বিপদের হাত থেকে বাঁচিয়ে এনেছেন তিনি।
এমনকি, ইউক্রেনে আটকে পড়া পড়ুয়াদের পরিশ্রমের কাছে তাঁর কষ্ট যে কিছুই নয় সেই প্রসঙ্গও বারংবার উপস্থাপিত করেন মহাশ্বেতা। এই প্রসঙ্গে তিনি জানান যে, “সত্যিই এ এক অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা। পড়ুয়ারা যে রাস্তা দিয়ে ইউক্রেন ছেড়ে এসেছেন, সেখানে কোনো খাবারদাবারের দোকান ছিল না। তার মাঝেই চার দিকে গুলি ছুটছে। মাইলের পর মাইল হেঁটে তাঁরা এসেছেন পোল্যান্ড। বিমানে উঠেও ওঁদের বিশ্বাসই হচ্ছিল না, যে তাঁরা নিরাপদস্থানে চলে এসেছেন। ওঁরা সে সময়ে এতটাই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন, যে তখন নিজেকে ঠিক রাখাটাই ছিল কঠিন কাজ।’’
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মহাশ্বেতার উড়ান সংস্থা প্রায় সাত হাজার পড়ুয়াকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে এনেছে। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন বাংলার এই কন্যা। রীতিমত নাওয়া-খাওয়া ভুলে দেশের কাজে এগিয়ে এসেছেন তিনি। এই ঘটনায় সকলেই ভূয়সী প্রশংসা করে কুর্ণিশ জানিয়েছেন মহাশ্বেতাকে।