বাংলা হান্ট ডেস্ক: আর জি কর (R G Kar Medical College) কাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে গর্জে উঠেছে সমগ্র রাজ্য তথা দেশ। কলকাতার এই স্বনামধন্য হাসপাতালে যে ঘৃণ্য ঘটনা ঘটেছে তাতে শিউরে উঠেছেন সকলেই। শুধু তাই নয়, ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ফের প্রশ্নের মুখে পড়েছে মহিলাদের নিরাপত্তার বিষয়টিও। এদিকে, বর্তমানে আর জি কর হাসপাতাল এই নিন্দনীয় ঘটনার জন্য আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও আপনি কি জানেন এই হাসপাতালের (R G Kar Medical College) ইতিহাস সম্পর্কে? শুধু তাই নয় এই হাসপাতাল তৈরিতে কিভাবে একজন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন সেই বিষয়টিও অনেকেরই অজানা। বর্তমান প্রতিবেদনে আজ আমরা এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত করছি।
আর জি কর মেডিক্যাল (R G Kar Medical College) কলেজের ইতিহাস:
মূলত, আজ আমরা আপনাদের কাছে আর জি কর তথা রাধাগোবিন্দ করের প্রসঙ্গে জানাবো। যিনি তৎকালীন যুগে একজন বিলেত ফেরত ডাক্তার হয়েও গ্রামের মানুষের চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করেননি। শুধু তাই নয়, বেলগাছিয়া থেকে দমদম পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি সাইকেল চালিয়ে তিনি পৌঁছে যেতেন রোগীদের কাছে। মাথায় টুপি এবং সাইকেলে ঝুলনো ক্যামবিসের ব্যাগ ছিল তাঁর সঙ্গী। বেশিরভাগ রোগীই আর্থিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল হওয়ায় রোগীদের পথ্য কেনার পয়সাও দিতেন ডাক্তারবাবুই। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল,। ১৮৯৯ সালে ভগিনী নিবেদিতার সাথে একজোট হয়ে রাধাগোবিন্দ কর কলকাতায় রীতিমতো মহামারীর আকার ধারণ করা প্লেগের সংক্রমণ রুখতে কাজ করেছিলেন
জানিয়ে রাখি যে, তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত বাংলায় রাধাগোবিন্দ কর ছিলেন চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতম রেনেসাঁ পুরুষ। বাংলার মানুষদের কাছে চিকিৎসা ব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে তিনি আজীবন লড়াই করে গিয়েছেন। আর সেই লড়াইয়ের সুবাদেই বেঁচেছে হাজার হাজার প্রাণ। ১৮৫২ সালের ২৩ অগাস্ট জন্মগ্রহণ করেন আর. জি. কর। হাওড়া জেলার রামরাজাতলা স্টেশনে নেমে মিনিট পনেরোর পথ পেরোলেই পৌঁছে যাওয়া যায় বেতড়ের বিখ্যাত কর বাড়িতে। তাঁর বাবা ছিলেন দুর্গাদাস কর। যিনি ঢাকায় মিডফোর্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এদিকে, একদম ছোট থেকেই পড়াশোনায় অত্যন্ত মেধাবী রাধাগোবিন্দ কর হেয়ার স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করেন। পরবর্তীকালে চিকিৎসা বিজ্ঞানের পাঠ গ্রহণের জন্য তিনি ১৮৮০ সালে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন।
এদিকে, পড়াশোনায় তুখোড় হওয়ার পাশাপাশি থিয়েটারের প্রতিও তুমুল টান ছিল তাঁর। ১৮৮৩ সালে রাধাগোবিন্দ স্কটল্যান্ডে পাড়ি দিয়ে ভর্তি হন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ১৮৮৭ সালে তিনি MRCP ডিগ্রি হাসিল করেন। যেদিকে চিকিৎসাবিদ্যার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডিগ্রি হিসেবে বিবেচিত করা হয়। এমতাবস্থায়, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন প্রত্যেকেই তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলেন ইংল্যান্ডে থেকে গিয়ে ডাক্তারি করার জন্য। কিন্তু, তাঁর ভাবনা ছিল অন্য। তিনি নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে ফিরে আসেন তাঁর মাতৃভূমিড়তে। আর সেখানেই গরিব মানুষের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন “মসীহা”। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে ইউরোপিয় চিকিৎসা শিক্ষা ব্যবস্থায় পড়ানো হত চিকিৎসাবিদ্যা। যেকারণে বঙ্গের পড়ুয়ারা পড়তেন সমস্যায়। কারণ, বাংলা ভাষায় চিকিৎসাবিজ্ঞানের কোনও বই তখন ছিল না।
তাই, এই গভীর সঙ্কট দূর করতে রাধা গোবিন্দ চিকিৎসাবিজ্ঞানের বই লেখার কাছে হাত দিয়েছিলেন। তাঁর প্রথম বই প্রকাশ পেয়েছিল ১৮৭১ সালে। যেটির নাম ছিল “ভিষগবন্ধু”। এদিকে, অন্যান্য বইগুলির মধ্যে অন্যতম হল, “রোগী পরিচর্যা”, “ভিষক সুহৃদ”, “সংক্ষিপ্ত শারীরতত্ত্ব”, “প্লেগ”, “স্ত্রীরোগের চিত্রাবলী ও সংক্ষিপ্ত তত্ত্ব”, “সংক্ষিপ্ত শিশু ও বাল চিকিৎসা”, “সংক্ষিপ্ত ভৈষজতত্ত্ব”, “কর সংহিতা”, “কবিরাজ ডাক্তার সংবাদ” ইত্যাদি। বাংলা ভাষাতেই লেখা হয়েছিল প্রত্যেকটি বই। যেগুলি ইংরেজি যারা ডাক্তারি ক্লাসের পড়ুয়াড়াও পড়তেন। এদিকে বই লেখার পাশাপাশি রাধাগোবিন্দ চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের চিকিৎসার জন্য তিনি একটি হাসপাতাল তৈরি করবেন। যদিও, এই কাজে বিপুল অর্থের চিন্তা তাঁকে গ্রাস করেছিল। যদিও, তিনি ঠিক করেছিলেন অর্থ জোগাড় করার জন্য তিনি ভিক্ষে পর্যন্ত করবেন এবং নিজের সমস্ত কিছু বিক্রি করে দেবেন।
আর এই ভাবনাকে সঙ্গী করেই কলকাতার ধনী ব্যক্তিদের কাছ থেকে তিনি অর্থ সংগ্রহ করতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, তৎকালীন কলকাতার কোনও ধনী বাড়িতে বিয়েবাড়ি সহ অন্যান্য কোনও অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে রাধাগোবিন্দ বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে আমন্ত্রিতদের উদ্দেশ্যে হাসপাতাল তৈরির জন্য অর্থ সাহায্য চাইতেন। এদিকে, বিলেত ফেরত একজন MRCP ডাক্তারের এহেন কর্মকাণ্ড অনেকেই বাঁকা চোখে দেখলেও অধিকাংশজনই অবাক হয়ে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সাহায্যের হাত। শত অপমান সহ্য করে এবং সমস্ত প্রতিবন্ধকতাকে দূরে সরিয়ে রেখে তিনি হাসপাতাল তৈরির জন্য অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যান। শুধু তাই নয়, এই মহানুভব চিকিৎসক হিসেবে অর্জিত অর্থের সমস্তটাই দান করে গিয়েছেন মেডিক্যাল কলেজ (R G Kar Medical College) ও হাসপাতাল স্থাপনে।
আরও পড়ুন: “মানুষ বলার অযোগ্য….”, আর জি কর কাণ্ডে সৌরভের বিরুদ্ধে গর্জে উঠলেন শ্রীলেখা, স্পষ্ট জানালেন….
আর এইভাবেই অর্থ সংগ্রহের মাধ্যমে এবং নিজের যাবতীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে তিনি ২৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বেলগাছিয়ায় ১২ বিঘা জমি কিনে নেন। সেখানেই তৈরি হয়েছিল হাসপাতাল (R G Kar Medical College)। যেটিতে খরচ হয় ৭০ হাজার টাকা। ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে এসে ১৮ হাজার টাকা দান করেছিলন স্বয়ং প্রিন্স অ্যালবার্ট ভিক্টর। এমতাবস্থায়, প্রথমে ওই হাসপাতালের নাম রাখা হয় “অ্যালবার্ট ভিক্টর হাসপাতাল”। তারপরে ১৯০৪ সালে রাধাগোবিন্দের এই উদ্যোগের সঙ্গে একত্র হয় কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস অব বেঙ্গল। তার ঠিক ১০ বছর পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনের পর বেলগাছিয়া মেডিক্যাল কলেজের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এদিকে, ১৯১৬ সালের ৫ জুলাই ওই মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতল ভবনের উদ্বোধন করেন লর্ড কারমাইকেল। তখন ওই মেডিক্যাল কলেজের নাম বদলে হয় কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ। যে নামটি থেকে গিয়েছিল স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত।
আরও পড়ুন: বাজারে এবার উঠবে ঝড়! Vivo নিয়ে আসছে এই দুর্ধর্ষ স্মার্টফোন, ফিচার্স জানলে হয়ে যাবেন “থ”
পরবর্তীকালে ১৯৪৮ সালে তীব্র আর্থিক সঙ্কটের সময় ওই মেডিক্যাল কলেজের ফের নাম বদলের দাবি ওঠে। কিন্তু, পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় তা হতে দেননি। বরং, তাঁর উদ্যোগেই চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ করের (R G Kar Medical College) নামেই কলেজের নাম রাখা হয়। আর সেই নামই এখনও পর্যন্ত বজায় রয়েছে। জানিয়ে রাখি যে, ১৯১৮ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছিলেন স্বনামধন্য চিকিৎসক রাধাগোবিন্দ কর। মৃত্যুর সময়ে তাঁর নিজস্ব সম্পত্তি বলতে ছিল শুধুমাত্র বেলগাছিয়ায় একটি বাড়ি। যদিও, সেই বাড়িটিও তিনি উইল করে দান করে যান মেডিক্যাল কলেজকে। রোগীদের সঠিক পরিষেবা প্রদানের লক্ষ্যে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর ছিল। শুধু তাই নয়, রোগীদের যাতে বেশি দামে বিদেশি ওষুধ কিনতে না হয় সেদিকেও নজর দিয়েছিলেন তিনি। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের আত্মজীবনী “লাইফ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্সেস অব আ বেঙ্গল কেমিস্ট” থেকে জানা যায় যে, ভারতের প্রথম ফামার্সিউটিক্যাল সংস্থা তৈরির সময়ে দেশীয় পদ্ধতিতে ওষুধ তৈরির কাজে রাধাগোবিন্দ করের বিশেষ অবদান ছিল। আর এইভাবেই বাংলার চিকিৎসা ব্যবস্থার অন্যতম প্রাণপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন রাধাগোবিন্দ কর।