শূন্য থেকে শুরু করে আকাশছোঁয়া সাফল্য! তারপরেই পতন, কিভাবে কেঁপে উঠল আদানি সাম্রাজ্যের ভিত?

বাংলা হান্ট ডেস্ক: একটা রিপোর্ট, আর তারপরেই কেঁপে উঠল সুবিশাল আদানি সাম্রাজ্যের ভিত। শুধু তাই নয়, মাত্র ৯ দিনের ব্যবধানেই ঘটল মহাপতনও। লাফিয়ে কমল কোম্পানির শেয়ারের দাম, হ্রাস পেল মোট সম্পদের পরিমান। একটি রিপোর্টের জেরেই এই কদিনেই রীতিমতো চরম বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করে ফেলল আদানি গ্রূপ (Adani Group)। মূলত, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের (Hindenburg Research) ওই রিপোর্টে একের পর এক চাঞ্চল্যকর অভিযোগ করা হয় আদানি গ্রূপের বিরুদ্ধে।

হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ: এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ হল একটি বিনিয়োগ গবেষণা সংস্থা। এই সংস্থার মূল লক্ষ্য হল শর্ট-সেলিংকে কাজে লাগিয়ে মুনাফা করা। নাথান অ্যান্ডারসন হলেন সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা। যেটির সদর দফতর রয়েছে নিউ ইয়র্কে। মূলত, এই সংস্থা কর্পোরেট জালিয়াতি এবং ফাঁকি দেওয়ার মতো ঘটনাগুলি ফাঁস করে থাকে। ইতিমধ্যেই তারা ক্লোভার হেলথ, কান্ডি, লর্ডসটাউন মোটরস, নিকোলা, টেকনোগ্লাসের মতো সংস্থার শেয়ার জালিয়াতির রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। তবে, এবার তাদের রাডারে রয়েছে আদানি গ্রূপ।

এমতাবস্থায়, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে যে, বর্তমানে আদানি গোষ্ঠীর ওপর বিপুল পরিমান ঋণ রয়েছে। পাশাপাশি, অ্যাকাউন্টিং সংক্রান্ত সমস্যাও রয়েছে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, ওই রিপোর্টে স্পষ্টভাবে দাবি করা হয়েছে, আদানি গ্রুপ বেশ কয়েক বছর ধরেই স্টক ম্যানিপুলেশন এবং অ্যাকাউন্টিং জালিয়াতিতে জড়িত রয়েছে। আর এহেন অভিযোগ সামনে আসতেই ক্রমশ কমতে থাকে আদানি গ্রূপের অন্তর্ভুক্ত শেয়ারগুলির দাম।

এদিকে, আদানি গ্রুপের বর্তমান সঙ্কটের পেছনে হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট থাকলেও বর্তমানে নানা ধরণের বক্তব্য উঠে আসছে। অনেকেই মনে করছেন, আদানি গ্রুপকে টার্গেট করার জন্য এই ঘটনা ঘটেছে। আবার অনেকের মতে, আদানি গ্রূপ তার সাম্রাজ্য সম্পর্কে যা যা বলেছে তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু লুকিয়ে রেখেছে। এমনকি, ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে শুরু হয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক তরজা।

মুম্বাইতে শেয়ারের ক্রমাগত পতনের কারণে বাজারে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে দেশের রাজধানী দিল্লিতে বিরোধীরা সংসদে হট্টগোল করেছেন। বিরোধীদের দাবি, আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। পাশাপাশি, তদন্তের জন্য জেপিসি গঠন করার দাবিও জানিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে সকলেরই নজর রয়েছে সামগ্রিক পরিস্থিতির ওপর। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে, আদানি গ্রুপের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন রিপোর্টকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে মোদী সরকারকে ক্রমাগত নিশানা করেছে বিরোধীরা।

লোকসান হয়েছে ৮ লক্ষ কোটি টাকার: হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট সামনে আসার পরে আদানি গ্রুপের প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। শুধু তাই নয়, যাঁরা আদানি গ্রূপে বিনিয়োগ করেছিলেন তাঁরাও ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। এমতাবস্থায় কংগ্রেসের অভিযোগ, গৌতম আদানি দেশের সবচেয়ে বড় কর্পোরেট জালিয়াতি করেছেন। এদিকে, আদানি ও আম্বানির প্রসঙ্গে দীর্ঘদিন ধরেই মোদী সরকারকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছেন রাহুল গান্ধী। এমন পরিস্থিতিতে, এহেন বিরোধিতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

কি জানিয়েছে LIC: পাশাপাশি, বিরোধীরা অভিযোগ করেছিলেন যে, LIC থেকে শুরু করে SBI প্রতিটি ক্ষেত্রেই মানুষের কষ্টার্জিত টাকাকে রীতিমতো লুঠ করেছে মোদী সরকার। এছাড়াও, গ্রামীণ এলাকায় সরকারি ব্যাঙ্কে নগদ টাকা ফুরিয়েছে বলেও দাবি করেন তাঁরা। ঠিক সেই আবহেই এবার LIC-র ব্যালেন্স শিট সামনে এসেছে। যেখান থেকে জানা গিয়েছে, ৩১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত, LIC দ্বারা ইক্যুইটি এবং ঋণের আকারে আদানি গ্রুপের কোম্পানিগুলির মোট শেয়ার মূলধন হল ৩৫,৯১৭ কোটি টাকা। এদিকে গত কয়েক বছরে কেনা ইক্যুইটির মোট ক্রয়মূল্য হল ৩০,১২৭ কোটি টাকা। পাশাপাশি, গত ২৭ জানুয়ারি বাজার বন্ধ হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগের বাজার মূল্য ছিল ৫৬,১৪২ কোটি টাকা। জানা গিয়েছে, LIC-র মোট সম্পত্তির পরিমান হল ৪১.৬৬ লক্ষ কোটিরও বেশি। যা আদানি গ্রুপের বিনিয়োগের এক শতাংশেরও কম।

ঋণের চেয়েও বেশি সম্পদ আদানির: এবার আমরা যদি অন্যান্য ব্যাঙ্কের বিনিয়োগের রিপোর্ট দেখি, তাহলে দেখা যাবে PNB প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে এবং SBI আদানিকে প্রায় ২১,০০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে। আদানি গ্রুপের বিনিয়োগ এবং ঋণ সম্পর্কে যে রিপোর্ট আসছে তাতে দেখা যাচ্ছে যে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের ঝুঁকি থাকলেও সব টাকা যে নষ্ট হয়ে যাবে তা নয়, কারণ আদানি গ্রুপের সম্পদ ঋণের থেকেও বেশি রয়েছে।

কোন ৭ টি কারণের জন্য সমগ্ৰ বিশ্বে শিরোনামে উঠে এসেছে আদানি গ্রূপ:
১. গত ৯ দিনে আদানি গ্রুপের আনুমানিক ৮ লক্ষ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
২. গৌতম আদানির মোট সম্পদের পরিমান ২৪ বিলিয়ন ডলার কমে ৬১.৩ বিলিয়ন ডলার হয়েছে।
৩. বিশ্বের বিলিয়নেয়ারদের তালিকায় গৌতম আদানি দ্বিতীয় স্থান থেকে নেমে আপাতত ২১ নম্বর স্থানে রয়েছেন।
৪. RBI সমস্ত ব্যাঙ্ককে আদানি এন্টারপ্রাইজকে দেওয়া ঋণের তথ্য দিতে বলেছে।
৫. আদানি গ্রুপের ১০ টির মধ্যে ৫ থেকে ৯ টি শেয়ারের দাম কমেছে।
৬. আদানি গ্রুপ ২০,০০০ কোটি টাকার সম্পূর্ণ সাবস্ক্রাইব করা FPO বাতিল করার এবং বিনিয়োগকারীদের টাকা ফেরত দেওয়ার কথা বলেছে।
৭. সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল আমেরিকান গবেষণা সংস্থা হিন্ডেনবার্গের রিপোর্ট বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে আদানিকে।

মাত্র ৯ দিনেই বড়সড় পতন আদানি সাম্রাজ্যে: একটা সময়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছিলেন গৌতম আদানি। অথচ আজ তিনি শীর্ষ ২০ ব্যক্তির তালিকা থেকেই ছিটকে গিয়েছেন। প্রতিবেদনটি লেখার সময় পর্যন্ত আদানির মোট সম্পদের পরিমান কমে হয়েছে ৬১.৩ বিলিয়ন ডলার। যার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের তালিকায় নেমে এসেছেন ২১ নম্বর স্থানে।

gautam adani

পাশাপাশি, ভারতের অন্য আরেক ধনকুবের মুকেশ আম্বানি মোট সম্পদের বিচারে আদানির তুলনায় অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছেন। আপাতত ৮০.৩ বিলিয়ন ডলারের অধিকারী হয়ে আম্বানি এই তালিকায় রয়েছেন দ্বাদশ স্থানে। এদিকে, ইতিমধ্যেই বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় FPO প্রত্যহারের সিদ্ধান্ত নেন আদানি। যার পরিপ্রেক্ষিতে আদানি গ্রুপ ২০,০০০ কোটি টাকার সম্পূর্ণ সাবস্ক্রাইব করা FPO বাতিল করার এবং বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এই প্রসঙ্গে একটি ভিডিও বার্তাও দেন আদানি। এদিকে, সামগ্রিকভাবে আদানি গ্রূপের বর্তমান পরিস্থিতি বিচার করে আসন্ন সময়ে আদানি গ্রুপ ফের স্বমহিমায় ফিরে আসতে পারে কি না এই প্রশ্নই তীব্র হচ্ছে সব মহলে।

Sayak Panda
Sayak Panda

সায়ক পন্ডা, মেদিনীপুর কলেজ (অটোনমাস) থেকে মাস কমিউনিকেশন এবং সাংবাদিকতার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করার পর শুরু নিয়মিত লেখালেখি। ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা হান্ট-এর কনটেন্ট রাইটার হিসেবে নিযুক্ত।

সম্পর্কিত খবর