দুটি হাত নেই, তাই পা দিয়েই অঙ্ক সেখান জগন্নাথ বাবু

নিজস্ব সংবাদদাতা,পূর্ব বর্ধমান –ইচ্ছে শক্তি প্রবল হলে মানুষ পারে না এমন কোন কাজ নেই । তারই প্রমান মিললো আউশগ্রামের জগন্নাথের । লোকে বলে বই -খাতায় পা দিতে নেই৷ কিন্ত্তু আমি কী করব ?’ সত্যিই কিছু করার নেই জগন্নাথের৷ জন্মের থেকেই তাঁর দুটি হাতই নেই। সে-কারণে সাধ থাকলেও প্রভু জগন্নাথদেবের রথের রশি টানতে পারেন নি প্রতিবন্ধী জগন্নাথ বাউরি। পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামের এই জগন্নাথ রথের দিন প্রভু জগন্নাথদেবকে স্মরণে ব্রতী হন ঠিকই, তবে দু-হাত না থাকায় রথের রশি টানতে না পারার বেদনা আজও তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়।

কিন্ত শারীরিক ভাবে যেহেতু সে অক্ষম তাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর তাকে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। তবু সে হাল ছাড়েনি, শুধুমাত্র মনোবল আর বাবার ও মায়ের কথায় আস্থা রেখেই ক্রমাগত লড়ে গেছে সে।মা, বাবার চাওয়া পাওয়ার প্রধান কেন্দ্রবিন্দু ছিল শুধু একটাই বিষয়। এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে সে যেন অন্ততঃ নিজের পায়ে দাঁড়াক ।

পূর্ব বর্ধমান জেলার আউশগ্রাম ১ ব্লকের বেরেন্ডা পঞ্চায়েতের বেলুটি গ্রামে বাড়ির বছর ৩৫ বয়সি এই জগন্নাথ বাউরি। তিনিই বাড়ির বড় ছেলে। তাঁর ছোট ভাইয়ের নাম বলরাম। জগন্নাথবাবু বলেন, জন্মের সময় থেকেই তাঁর দুটি হাতই নেই। তখন থেকেই গ্রামের সবাই তাঁকে জগন্নাথদেবের সঙ্গে তুলনা করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, তাঁর বাবা লক্ষ্মণচন্দ্র বাউরি ও মা সুমিত্রা বাউরি মনে করতেন প্রভু জগন্নাথদেবের আশীর্বাদেই একদিন তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। স্কুলে ভর্তি করানোর জন্য শৈশবে তাঁর বাবা তাঁকে বেলুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যান। সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভূতনাথ পাল মহাশয় তাঁর বাবাকে বলেন, প্রভু জগন্নাথদেবকে স্মরণ করে তোমার ছেলের নাম রাখো জগন্নাথ। বাবা লক্ষণচন্দ্র বাউরি প্রধান শিক্ষক মহাশয়ের সেই কথা মেনে নিয়ে নাম রাখেন জগন্নাথ । আর সেদিন থেকেই জগন্নাথ বাউরি নামেই তার পরিচিতি হয় ।IMG 20190731 WA0065 427x320 1

 

তারপর শুরু হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশুনার জীবন। দিন আনা দিন খাওয়া বাউরি পরিবারে সকলের কাছে আজও সবেতেই ভরসা রাখেন প্রভু জগন্নাথদেবের উপরেই। একসময়ে বাবা-মা ক্ষেতমজুরির কাজ করে সংসার চালাতেন। জগন্নাথ বাউরির বলেন, তাঁর পা ধরে পায়ে পেনসিল গুঁজে দিয়ে লেখা শিখিয়ে ছিলেন প্রথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ভূতনাথ পাল। পা দিয়ে লেখালেখি শিখেতে পারার পর থেকেই তাঁর লেখাপড়া শেখার আগ্রহ অনেক বাড়তে থাকে । শত কষ্টের মধ্যে দিয়েও তিনি লেখাপড়া ঠিক চালিয়ে যান। সাফল্যের সঙ্গে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি বেসিক ট্রেনিং কোর্সে ভর্তি হন। ট্রেনিং সম্পূর্ণ করে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি পান। পায়ের দু’আঙুলের ফাঁকে ধরা চক । বোর্ডের গায়ে হেলান দিয়ে লিখে চলেছেন লাইনের পর লাইন । কষে চলেছেন একের পর এক অঙ্ক । মাস্টার মশাইয়ের কথা পড়ুয়ারা শুনছে মন দিয়ে । ক্লাসে পায়ে লিকেই পড়ান জগন্নাথ বাবু। জ্যামিতি শেখানোর সময় নিখুঁত বৃত্ত আঁকা থেকে শুরু করে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ সবই শেখাচ্ছেন পায়ে লিখে। পড়াশোনা এবং কাজের প্রতি আদ্যম জেদ , তাই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা বাধা হয়নি জগন্নাথের। হাত না থাকায় লেখাপড়া চালানোর জন্য পা-ই ছিল তাঁর প্রধান ভরসা। তাই পা দিয়েই চালিয়েছেন তাঁর পড়াশুনা।

জগন্নাথবাবু জানান, জন্ম থেকেই দু’হাত নেই। উচ্চতাও অনেক কম। শারীরিক প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে সঙ্গী ছিল দারিদ্রও। তবুও জীবন যুদ্ধে হাল ছাড়েনি জগন্নাথ বাউরি । বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি আউশগ্রামের জয়কৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। স্ত্রী লক্ষী, বাবা, মা, ভাই, বোন সবাইকে নিয়ে এখন ভরা সংসার জগন্নাথবাবুর। বিদ্যালয়ের সহকর্মী ,ছাত্র-ছাত্রী সকলেই তাঁদের প্রিয় জগন্নাথ স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এই বাউরি পরিবার রথযত্রা উৎসবের দিনটি ভক্তি সহকারে পালন করেন। জগন্নাথ বাউরি বলেন, প্রভু জগন্নাথদেবের দুটি হাত নেই। তাঁরও জন্ম থেকে দুটি হাত নেই। সেকারণেই তাঁর নাম রাখা হয় জগন্নাথ। তাই জ্ঞান হবার পর থেকে প্রভু জগন্নাথদেবকেই তিনি দেবতা মেনে আসছেন। তাই লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি শুরু করি।


Udayan Biswas

সম্পর্কিত খবর