চোখের সামনে মৃত্যুমিছিল! সতর্ক করতে গিয়ে লাইভে কেঁদে ফেললেন কলকাতার চিকিৎসক

বাংলা হান্ট ডেস্কঃ কোভিডের এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধে ফ্রন্ট লাইনে দাঁড়িয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা। তাদের পোশাক সাদা অ্যাপ্রোন, আর হাতে অস্ত্র বলতে গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ। চলেছে রাতদিন অদম্য শারীরিক এবং মানসিক পরিশ্রম। তাও কখনো কখনো অসহায় ভাবেই হেরে যেতে হচ্ছে যুদ্ধে। পিছন ফিরে তাকানোর সময় নেই কারণ সামনে আরো অনেক মানুষ রয়ে গেছেন একটুখানি সাহায্যের অপেক্ষায়। তেরোশো রোগীর জন্য মাত্র একজন চিকিৎসক আমাদের এই রাজ্যে। চোখের সামনে সামান্যতম দেরি হলেই দেখতে হচ্ছে অসহায় মৃত্যু। এমতাবস্থায় মানসিক দৃঢ়তা কতক্ষণ ধরে রাখা সম্ভব? এই কারণেই নিজের ফেসবুক লাইভ থেকে মানুষজনকে সচেতন করতে এসে হঠাৎই কেঁদে ফেললেন ডাক্তার অনির্বাণ বিশ্বাস। একের পর এক এই অসহায় মৃত্যু আর মেনে নিতে পারছেন না তিনি। রাজ্যের প্রতিদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছেন শতাধিক নাগরিক। অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসা শুরু করতে দেরি হয়ে যাচ্ছে প্রচন্ড। আর সেই কারণেই আপ্রাণ চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাচ্ছে না রোগীদের।

সারাদিনের কাজের পর ফেসবুক লাইভে মানুষকে সচেতন করতে প্রায় রোজই আসেন ডক্টর অনির্বাণ বিশ্বাস। নিজের কোভিড ওয়ার্ডের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতা মানুষের সাথে ভাগ করে নিতে গিয়ে এদিন কেঁদে ফেলেন তিনি। তিনি বলেন, “গতবারের চেয়ে এবার এ আরো ভয়াবহ হয়ে দেখা দিয়েছে করোনা। তার কারণ সংক্রমণের হার বাড়ছে। আর দ্বিতীয় কারণ, সর্দি কাশি জ্বর বা পেটের রোগে যারা ভুগছেন তারা নিজেরাই বাড়িতে চিকিৎসা শুরু করছেন। চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন না। সাত-আট দিন দেরিতে যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছাচ্ছে না তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে আমরা আজকে চাইলে কালকের মধ্যে পরিকাঠামো বাড়াতে পারি না। আমার একশোটা বেড আছে। কালকের মধ্যে দশ হাজার বেড আনা সম্ভব নয়।”

কোভিডের ক্ষেত্রে এই মুহূর্তে রোগী ভর্তির চাপ প্রচন্ড। আর সেই কারণেই মানুষকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। অনির্বাণ বাবু জানান, গত বছর কোভিডের গোষ্ঠী সংক্রমণ ছিলনা। এ বছর তা শুরু হয়েছে। ফুসফুসের সমস্যা দানা বাঁধছে, তৈরি হচ্ছে আনুষঙ্গিক অনেক সমস্যাও। বেড নিয়ে হাহাকার, অক্সিজেন নিয়ে হাহাকারের কথা স্বীকার করে নেন তিনি। সাথে সাথে তিনি এও বলেন, এটা তাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে যারা সময়ে চিকিৎসা শুরু করছেন না। বলতে বলতেই তিনি ভেঙে পড়েন কান্নায়। তার কথায়, “এত হাহাকার আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। রোগীদের অনেকেরই অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৭০-৭২ এ নেমে যাচ্ছে। গুরুতর অবস্থা দেখলেই আমি তাদের হাসপাতালে যেতে বলছি। কিন্তু সেখানেই বা বেড কোথায়? সকলের তো বেসরকারি নার্সিংহোমে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই।”

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, গত কয়েকদিনে কোভিডের পরিমাণ যথেষ্ট বেড়েছে রাজ্যে। দেশের বেশ কিছু রাজ্য যখন আস্তে আস্তে সামলে ওঠার চেষ্টা করছে তখন আমাদের রাজ্যে প্রতিদিনই বাড়ছে সংক্রমণ। শেষ ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে নতুন করে সংক্রমিত হয়েছেন ১৯ হাজার ৫১১ জন। যদিও তা গতদিনের তুলনায় কিছুটা কম। তবে এই নিয়ে আমাদের রাজ্যে আক্রান্ত হলেন প্রায় এগারো লক্ষেরও বেশি মানুষ। পরিস্থিতি ক্রমাগত চলে যাচ্ছে হাতের বাইরে। এ কথা মাথায় রেখেই এদিন অনির্বাণ বাবু বলেন, “হাতজোড় করে বলছি, সকলে সতর্ক হোন। অসুবিধা হলেই চিকিৎসকের কাছে আসুন। বাড়ির মহিলা যাঁরা, মা, মাসিমা, কাকিমা, পিসিমা তারা বরাবর রোগ চেপে রাখেন। তাদের প্রতি যত্ন নিন।”

একথা ঠিক যে ক্রমাগত আরো ভয়ানক হয়ে উঠছে মহামারী করোনা৷ লকডাউন জারি হলেও মানুষের মধ্যে সচেতনতার অভাব এখনো যথেষ্ট স্পষ্ট। গতকালও বিশাল ভিড় করে মদের দোকানের সামনে লাইন দিয়েছেন মানুষ। এই অথচ অসচেতনতার কারণে চিকিৎসকদের জন্য কাজটা যে আরও কঠিনতর হয়ে উঠছে তা বলাই বাহুল্য। একইসঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে চিকিৎসকদের ওপর দুর্ব্যবহার। অথবা কোভিড আক্রান্ত হলে কেউ কেউ এখনো তাদের একঘরে করে দিচ্ছেন। এই সংকীর্ণ মানসিকতা করে দিন দূরে সরিয়ে রাখতে অনুরোধ করেন অনির্বাণ বাবু। চিকিৎসকরা সামনে থেকে লড়ছেন। ভয়াবহ এই মহামারীর কবলে পড়ে প্রাণ হারাতে হচ্ছে তাদেরকেও। তাই তাদের প্রতিও কোনরকম হেনস্থা না করার বার্তা দেন তিনি।


Abhirup Das

সম্পর্কিত খবর