বাংলা হান্ট ডেস্কঃ নয়া দিল্লি, পৃথ্বীশ দাশগুপ্তঃ ভারতে এই প্রথম সদর্পে দশ বছর সম্পূর্ণতার পথে অ-কংগ্রেসি সরকার। আর কয়েক মাসের মধ্যে দেশজুড়ে হতে চলেছে দেশের সাধারণ নির্বাচন। আর ঠিক তার আগেই পাঁচ দিনের ডাকা বিশেষ সংসদীয় অধিবেশন তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছে দেশের রাজনৈতিক মহল। একদেশ-একনাম ,এক-আইন, এক-নির্বাচন নিয়ে সরগরম জাতীয় রাজনীতি, আর তার ফাঁকে জি-২০ অধিবেশনে অনেক চুক্তি সম্পাদিত হলো ভারত, ইউরোপ ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মধ্যে। এই চুক্তি হল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক করিডর তৈরির চুক্তি। আর এই করিডরের একটি বিশাল অংশ রয়েছে পাক অধিকৃত কাশ্মীরে। এই অঞ্চলকে ভারতের বলে জানিয়েছে আমিরশাহীর উপ-প্রধানমন্ত্রী সইফ বিন জাহেদ আল নাহিয়ান।
পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ভারতের অংশ বলার পর এই সংক্রান্ত একটি ম্যাপ প্রকাশ করেছে আমিরশাহীর উপপ্রধানমন্ত্রী। প্রকাশিত ম্যাপ ও দাবিকে কেন্দ্র করে এবার বন্ধু দেশ হিসেবে পরিচিত আমিরশাহীর সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি হতে পারে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। ১৮৪৬ সালে শিখ সেনাদের পরাজিত করার পর জম্মু কাশ্মীরের সঙ্গে এক ছবির মত পার্বত্য এলাকা গিলগিট বাল্টিস্তানও ব্রিটিশরা বিক্রি করে দেয় জম্মুর ডোগরা শাসক গুলাব সিংয়ের কাছে। কিন্তু মহারাজা গুলাব সিংয়ের কাছ থেকে লিজ নিয়ে এ এলাকার শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতেই রেখেছিল পাশতুনরা। ১৯৩৫ সালে পুণরায় সে লিজ নবীকরণ করা হয়।
যদিও ১৯৪৭ সালে কর্নেল পদমর্যাদার এক ব্রিটিশ সেনা অফিসার মহারাজা হরি সিংয়ের গভর্নরকে বন্দি করে ওই এলাকা হস্তান্তর করে পাকিস্তানের হাতে। ইতিহাস বলছে, ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ভারত ও পাকিস্তান স্বাধীনতা পাবার আগে থেকেই দুই পক্ষের মধ্যে বিতর্কের সূচনা হয়েছিল কাশ্মীর ভূখণ্ডের অধিকার নিয়ে।
‘ইন্ডিয়ান ইনডিপেন্ডেন্স এ্যাক্ট’ নামে ব্রিটিশ ভারত বিভক্তির যে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল তাতে বলা হয়েছিল, কাশ্মীর তার ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত অথবা পাকিস্তান, যে কোন রাষ্ট্রেই যোগ দিতে পারবে। কাশ্মীরের তৎকালীন হিন্দু রাজা হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে, অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে।
১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলোর আক্রমণের মুখে পড়ে ভারতে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন রাজা হরি সিং। যার ফলে ভারতের সামরিক সহায়তা পায় সে, পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ। দু’বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের কারণে ১৯৪৮ সালে ভারত কাশ্মীর প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে। ১৯৪৯ সালের ১ জানুয়ারি সংঘর্ষবিরতির পর থেকে পাকিস্তান নিজেদের দখলে রেখেছে ১৩,২৯৭ বর্গ কিলোমিটার এলাকা, যা পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর বলে পরিচিত।
অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে চীন কাশ্মীরের আকসাই-চিন অংশটির নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে, আর তার পরের বছর ১৯৬৩ সালে একটি চুক্তি মাধ্যমে পাকিস্তান, কারাকোরামের ওপারে, শাক্সগাম এলাকায় জম্মু কাশ্মীরের ৫০০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা দিয়ে দেয় চিনকে। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে দ্বিতীয়বার ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হয় ১৯৬৫ সালে, ১৯৭১-এর যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সিমলা চুক্তির মধ্যে দিয়ে নির্দিষ্ট রূপ নেয় ‘লাইন অব কন্ট্রোল’ বা নিয়ন্ত্রণ রেখা।’ ১৯৮৪ সালে ভারত দখল করে সিয়াচেন হিমবাহ এলাকার নিয়ন্ত্রণ। কাশ্মীর এখন বিভক্ত লাইন অব কন্ট্রোল রেখা বরাবর। এ ছাড়াও আকসাই-চিন এবং সিয়াচেন হিমবাহের উত্তরের আরেকটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করে চীন।
যদিও পরবর্তী সময়ে কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে আমেরিকা মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলে ভারত তা নাকচ করে জানায় এটি দ্বিপাক্ষিক সমস্যা তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই, বরং রাষ্ট্রসংঘ পাকিস্তানকে অধিকৃত ভারত ভূখণ্ড অর্থাৎ POK ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করুক। এইমর্মে ১৯৯৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ভারতের সংসদে সর্বসম্মত ভাবে পাশ হওয়া প্রস্তাবে বলা ছিল, “জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যা ছিলো, আছে এবং থাকবে” একই সাথে দাবি করা হয়, “পাকিস্তান গায়ের জোরে জম্মু ও কাশ্মীরের যে অংশ নিজেদের দখলে রেখেছে তা ফিরিয়ে দিতে হবে দিতে হবে তাদের।”
২০১৭ সালের জনগণনা অনুসারে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের জনসংখ্যা ৪০ লক্ষ। এটি ১০ জেলায় বিভক্ত। এর মধ্যে কাশ্মীর সীমান্তবর্তী জেলাগুলি হল- নীলম, মুজফফরাবাদ, হাট্টিয়ান বালা, বাঘ, এবং হাভেলি। রাওয়ালকোট, কোটলি, মীরপুর, ও ভীমবের জেলা জম্মু লাগোয়া। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী হল মুজফফরাবাদ, যা ঝিলম নদীও তার শাখানদী নীলম (ভারতীয়দের কাছে কৃষ্ণগঙ্গা) উপত্যকায়, শ্রীনগরের সামান্য উত্তরে অবস্থিত।
২০১৯ সালের ৬ই আগষ্ট অমিত শাহ বলেন, ‘‘কাশ্মীরের সীমার মধ্যে পাক অধিকৃত কাশ্মীরও রয়েছে তা ফিরিয়ে আনার জন্য প্রাণও দিতে পারি।’’ জম্মু ও কাশ্মীর ভারতেরই অপরিহার্য অংশ এবং এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর (PoK)। লোকসভায় (Lok Sabha) একথা জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। জম্মু ও কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নিয়ে রাজ্যকে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় কেন্দ্রীয় সরকার।
এনিয়ে বিরোধীদের ক্ষোভ প্রদর্শনের মুখে পড়তে হয় অমিত শাহকে। তখনই তিনি জানান, ‘‘এটা কোনও রাজনৈতিক পদক্ষেপ নয়। সংসদের পূর্ণ ক্ষমতা রয়েছে দেশের জন্য আইন প্রণয়ন করার। ভারতের সংবিধান এবং জম্মু ও কাশ্মীরের সংবিধানে এমন করার সম্মতি রয়েছে।” তিনি আরও জানান, ‘‘কাশ্মীর ভারতের অখণ্ড অংশ। আমি এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার করে দিতে চাই যে যখনই আমরা জম্মু ও কাশ্মীর বলি, তার মধ্যে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরও পড়ে (গিলগিট-বালটিস্তান সহ) এবং আকসাই চিনও পড়ে। এ নিয়ে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত নয়। সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীর হল ভারতের অখণ্ড অংশ।”
২০২৩ সালের ২৬শে জুন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ে সিকিউরিটি কনক্লেভ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। সেই অনুষ্ঠানে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী পরিষ্কার জানিয়ে দেন যে, পাক অধিকৃত কাশ্মীর আমাদের ছিল, আমাদের আছে, আমাদেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে থাকবে। এই এলাকাকে বার বার নিজেদের বলে দাবি করে পাকিস্তান কিছুই করতে পারবে না। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর নিয়ে সংসদে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, পাক- অধিকৃত কাশ্মীর ভারতেরই অংশ। শুধু একটা নয়, পার্লামেন্টে অন্তত তিনটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে এই ব্যাপারে।
আর সাম্প্রতিক জি-২০ অধিবেশনে ভারত, ইউরোপ ও সংযুক্ত আরব আমিরশাহীর মধ্যে সম্পাদিত হওয়া আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক করিডর চুক্তি ইশারা করে যে পাক অধিকৃত অংশ ভারতেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এবং তা স্পস্টভাবে স্বীকার করে ইউরোপ সহ ইসলামিক রাষ্ট্রগুলির অন্যতম প্রধান সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। যা কূটনৈতিক দিক থেকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করে রাজনৈতিক মহল। ওই চুক্তির অন্তর্ভুক্ত অঞ্চলের মধ্যে রয়েছে PoK এর বিস্তৃর্ণ ভূখণ্ড, আর আরব আমিরশাহীর সহিত বিশেষ অর্থনৈতিক করিডর চুক্তি বাস্তবায়িত করতে হলে পাকিস্তান অধিকৃত অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ আসতে হবে ভারতের হাতে। যা কখনোই আলোচনার মাধ্যমে সম্ভব হবেনা বলেই মনে করে কূটনৈতিক মহল। আর এই কারণেই রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের ধারণা সরকার PoK নিয়ে কোন প্রস্তাব আনতে পারে এই বিশেষ অধিবেশনে।