বাংলা হান্ট ডেস্ক: “ক্যানসার” (Cancer), এই শব্দটা যেন প্রত্যেকের কাছেই এক বিভীষিকার সমান। সমগ্ৰ বিশ্বজুড়ে এই মারণ রোগ প্রতিবছরই কেড়ে নেয় হাজার হাজার মানুষের প্রাণ। তবে, বর্তমান সময়ের উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জীবনযুদ্ধে লড়াই করার প্রয়োজনীয় মানসিক জোরকে সঙ্গে করেই অনেকেই হারিয়ে দিচ্ছেন “ক্যানসার”-কে। এমতাবস্থায়, বর্তমান প্ৰতিবেদনেও আমরা আজ আমাদের রাজ্যেরই এমন এক হবু ডাক্তারের প্রসঙ্গ আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করব যিনি বিরল ক্যানসারকে হারিয়ে দিয়ে হুইলচেয়ারের ওপর ভরসা করেই রোগীদের পরিষেবা দিচ্ছেন।
মূলত, হবু ডাক্তার শৌভিক বিশ্বাসের শরীরে বাসা বেঁধেছিল “হজকিন লিম্ফোমা” নামের বিরল এক ক্যানসার। এক লক্ষ ব্লাড ক্যানসার রোগীর মধ্যে শতকরা ২.৬ জনের শরীরে এই ধরণের মারণ রোগ দেখা যায়। আর তাতেই আক্রান্ত হন শৌভিক। তবে, তাঁর ক্যানসার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনার প্রসঙ্গে জানাতে গেলে কয়েকবছর আগের প্রসঙ্গও উপস্থাপিত করতে হবে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মেরুদণ্ডের ডি সিক্স অস্ত্রোপচার হয় তাঁর। তার আগে শরীরজুড়ে অসহনীয় যন্ত্রণায় ভুগছিলেন তিনি। এমনকি, একটা সময়ে যন্ত্রণার তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে মৃত্যু পর্যন্ত চেয়েছিলেন শৌভিক।
তবে, চেন্নাইয়ের এক বেসরকারি হাসপাতালে মেরুদণ্ডের ডি সিক্স অস্ত্রোপচার হওয়ার পরও যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাননি তিনি। এমনকি, একটা সময়ে সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হতে হয় তাঁকে। এমতাবস্থায়, ২০১৭ সালে ব্যাঙ্গালোরের এক হাসপাতালে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করে তাঁকে জানানো যে, “হজকিন লিম্ফোমা” নামের বিরল ব্লাড ক্যানসারে আক্রান্ত হয়েছেন শৌভিক। আর তখন থেকেই তাঁর লড়াই শুরু ক্যানসারের বিরুদ্ধে।
এই প্রসঙ্গে শৌভিক জানিয়েছেন, ‘‘২০১৬ সালের মাঝামাঝি সেকেন্ড ইয়ার প্র্যাক্টিক্যালের পরীক্ষা চলাকালীন হঠাৎ বুকের বাঁদিকে অসম্ভব ব্যথা শুরু হয়। এমনকি, একটা সময়ে পাও ক্রমশ অসাড় হতে শুরু করে। তারপর আর লেখাপড়া করতে পারিনি। দিনে যতটা ব্যথা হত রাতে যেন তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণা হত। ছুরি দিয়ে বারংবার আঘাত করলে যে যন্ত্রণা হয় সেই অবস্থাই হত আমার। একটা সময়ে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করতে চাইতাম। কিন্তু তখন আমার সেই ক্ষমতাটুকুও ছিল না।”
এদিকে, ছেলের এমন শারীরিক অবস্থা দেখে শৌভিককে চিকিৎসার জন্য চেন্নাইতে নিয়ে যান শৌভিকের বাবা। তিনি রাজ্য সরকারের একজন পদস্থ আধিকারিক। সেখানেই মেরুদণ্ডের ডি সিক্স অস্ত্রোপচার হয় শৌভিকের। যদিও, যন্ত্রণার উপশম না হয়ে উল্টে শৌভিকের ওজন প্রায় ৩০ কেজি কমে যায়। একটা সময়ে কার্যত কঙ্কালসার অবস্থায় বিছানায় পড়ে থাকত হত শৌভিককে।
এই প্রসঙ্গে শৌভিকের মা কৃষ্ণাদেবী জানিয়েছেন “সেই সময়টাতে ওকে পাশ ফিরিয়ে দিতে হত। ২০১৭ সালের মে মাসের দিকে রোগটা ধরা পড়ল। ব্যাঙ্গালোরের একটি বিখ্যাত হাসপাতালেই ভরতি ছিল সে।” এদিকে, ক্যানসারের চিকিৎসা চলাকালীন কেমোথেরাপির জন্য ওষুধ আনা হত ইজরায়েল থেকে। যদিও, দু’টি কেমো কাজ করেনি। তবে, ক্যানসারের বিরুদ্ধে লড়াই না থামিয়ে শৌভিককে কলকাতায় ফিরিয়ে নিয়ে এসে ফের কেমোথেরাপি শুরু হয় “টাটা ক্যান্সার রির্সাচ সেন্টার”-এ।
এই লড়াইয়ের দিনগুলির প্রসঙ্গে শৌভিক জানান ‘‘আমার আগে মাত্র ছ’জনকে এই কেমো দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে চারজনই মারা যান। তবে, আমার কেমো সম্পূর্ণ হওয়ার পর হঠাৎ এক সিনিয়র ডাক্তারবাবু এবং তাঁর সহকারীরা এসে আমাকে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করলেন। তখনই শুনলাম তাঁরা বলছেন, একটা মিরাকল হয়ে আমি জিতে গিয়েছি। হজকিন লিম্ফোমার চিহ্ন আর আমার শরীরে নেই!”
এভাবে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজের ইন্টার্ন শৌভিক বিশ্বাসের জীবন থেকে তিনটে বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও অবশেষে ক্যানসারের বিরুদ্ধে চলা লড়াইতে জয়লাভ করেছেন তিনি। তবে, এখন তাঁকে রোজ নিয়ম করে ফিজিওথেরাপি করতে হয়। পাশাপাশি, উত্তর ২৪ পরগনার হৃদয়পুর থেকে রোজ সকাল ন’টায় গাড়ি করে হাসপাতালের আউটডোরে উপস্থিত হয়ে যান শৌভিক। হুইলচেয়ারে বসেই চলে রোগী দেখার কাজ। তবে, শৌভিকের সঙ্গে থাকেন তাঁর মা। দুপুর দু’টো পর্যন্ত আউটডোরে পরিষেবা দেওয়ার পর তিনি রওনা হন বাড়ির উদ্দেশ্যে। ইতিমধ্যেই শৌভিক এমডির জন্য প্রবেশিকার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছেন বলেও জানা গিয়েছে।