উচ্চশিক্ষিত হয়েও মেলেনিচাকরি, শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে ফেরি করছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে M.A করা যুবক

বাংলাহান্ট ডেস্ক: পশ্চিমবঙ্গে চাকরির অভাবে বহু উচ্চশিক্ষিত যুবক-যুবতীকে দেখা যায় উপার্জনের জন্য অন্য কোনও পথ বেছে নিতে। তেমনই এক পথ বেছে নিয়েছেন উত্তর দিনাজপুরের (North Dinajpur) রায়গঞ্জ ব্লকের মণিপুর অঞ্চলের কান্তরের বাসিন্দা রাজকুমার মাহাতো। পঁচিশ বছর বয়সি এই যুবক পেশায় একজন ফেরিওয়ালা। কিন্তু তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার সঙ্গে পেশার কোনও মিল নেই। দরিদ্র পরিবারের মুখে দু’বেলা দু’মুঠো খাবার তুলে দিতে প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রাম করে চলেছে উচ্চশিক্ষিত এই যুবক।

আদি বাড়ি কান্তরে হলেও পড়াশোনার জন্য আপাতত তাঁর ঠাঁই হয়েছে রায়গঞ্জ শহরের উকিলপাড়াতে। তবে শুধু উচ্চশিক্ষাই নয়, রাজকুমারের মধ্যে রয়েছে এক অসাধারণ প্রতিভা।  রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর হওয়ার পাশাপাশি ক্যারাটেতেও ব্ল্যাকবেল্ট সে। ছোট্ট ফেরিগাড়িতে মনিহারি সামগ্রী  সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো এই যুবকের স্বপ্নগুলি বেশ বড়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে পরিবারের সদস্যদের মুখে দু’মুঠো অন্ন তুলে দেয় রাজকুমার। জিনিস ফেরি করার পাশাপাশি সপ্তাহে ৩ দিন রায়গঞ্জ শহর ও শহরতলি এলাকায় ক্যারাটেরও প্রশিক্ষণ দিতে দেখা যায় তাঁকে। 

north dinajpur

রাজকুমারের পেশার সঙ্গে তাঁর শিক্ষাগরত যোগ্যতার কোনও মিল নেই। কিন্তু জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে এই পেশাকে বেছে নিয়েছে সে। রাজকুমারের বাবা পেশায় কৃষক। ২০১৫ সালে ভগিলতা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক ও ২০১৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে সে। এরপর রায়গঞ্জ সুরেন্দ্রনাথ কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়। তারপর রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে। এম এ পড়ার সময়েই রায়গঞ্জে চলে আসে রাজকুমার। মেলায় মেলায় বেলুন বিক্রি করে নিজের  পড়াশোনার খরচ দিতে থাকে। একটু অর্থ জোগাড় হতেই তা দিয়ে ভ্যানগাড়ি তৈরি করে মনিহারি সামগ্রী বিক্রি করতে শুরু করে সে। 

পাশাপাশি চলে তার ক্যারাটে প্রশিক্ষণ। ক্যারাটেতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়ার পর গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য মহারাজা মোড়ে একটি স্কুলও চালু করেছে সে। হাসিখুশি  রাজকুমারের ইচ্ছে অলিম্পিকে অংশ নেওয়া। তার বিশ্বাস, অংশ নিলে সে সোনা আনবেই। গত ২০ মার্চ রাজকুমার রায়গঞ্জ থেকে কলকাতার উদ্দ্যেশ্যে পায়ে হেঁটে রওনা দিয়েছিল। এই সফর সে শেষ করে ৬ দিনে। রাজকুমারের ইচ্ছে ছিল মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে  গ্রামেগঞ্জে ছেলেমেয়েদের  মোবাইল ফোনের অত্যাধিক ব্যবহার বন্ধের জন্য গ্রাম্য খেলাধুলার পরিবেশ ফিরিয়ে আনার দাবি জানাবেন।

north dinajpur

কিন্তু সেই সুযোগ পায়নি সে। রাজকুমার জানিয়েছে, ফেরি করে যা আয় হয় তা দিয়ে  চাকরির জন্য পড়াশোনার খরচ এবং সংসারের খরচ টুকু ওঠে। বাকি খরচ চালাতে কঠিন লড়াই করতে হয় তাকে। রাজকুমার বলে, “এখন নেট ও সেটের জন্য চেষ্টা করছি।” রাজকুমারের বাবা রামদেব মাহাতো গ্রামেই থাকেন। অন্যের জমিতে কাজ করেন। মা মিনাদেবী মাহাতো অসুস্থ । মা, বাবা ও চার ভাইবোন নিয়ে সংসার তাদের। উকিলপাড়ায় একটি ভাড়া বাড়িতে থাকে রাজকুমার। সজ্জন বাড়িওয়ালা এর জন্য তার থেকে এক পয়সাও ভাড়া নেন না। 

রাজকুমার আরও বলেছে, “আমার ইচ্ছে শিক্ষক হওয়ার। কিন্তু আমাদের মতো গরীব মানুষদের কাছে চাকরি স্বপ্নের মতো। কারণ এখন যোগ্যতার দাম নেই, টাকা দিলেই চাকরি মেলে”। নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে এমনিতেই অস্বস্তিতে রয়েছে সরকার। রাজকুমার যেন খানিক সেখানেই খোঁচা দিল তার কথার মাধ্যমে। রাজকুমারের বাড়ি গিয়ে দেখা গেল ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে অনেক মেডেল। জাতীয়,  রাজ্য ও জেলাস্তরে ক্যারাটেতে অংশ নিয়েছে সে। কোনওবার প্রথম, আবার কোনওবার দ্বিতীয় হয়েছে সে। তার আক্ষেপ, এত মেডেল রয়েছে, কিন্তু কোনো সম্মান নেই। 

প্রতিবেশীদের কাছেও অত্যন্ত নম্র ভদ্র এবং গুণী ছেলে বলে পরিচয় রাজকুমারের। প্রতিবেশী লক্ষ্মী চৌহান বলেন, “উচ্চশিক্ষিত হয়েও সে যেভাবে ফেরি করে নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার চালায় সত্যি ভাবা যায় না। এমন ছেলে আজকাল আর দেখা যায় না। ওর একটা চাকরি দরকার। পাড়ার ছেলেমেয়েরা খুব ভালোবাসে ওকে।” প্রসঙ্গত, প্রাথমিক ,মাধ্যমিক ,গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি  সকল ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ঠিক এমনই এক সময়ে রাজকুমারের লড়াই রাজ্য সরকারের ভূমিকার দিকে আঙুল তুলছে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

Subhraroop

সম্পর্কিত খবর