তন্ময় সাহাঃ
“এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম
আজ বসন্তের শূণ্য হাত –
ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও
আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।”
আধুনিক বাংলা কাব্যে সমাজ সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার আরেক নাম শঙ্খ ঘোষ। রাষ্ট্রে যখনই স্বৈরাচারী তার থাবা বসাতে চেষ্টা করেছে তখনই গর্জে উঠেছে তার কলম। কিন্তু চল্লিশের সুভাষ মুখোপাধ্যায় কিংবা পূর্ববর্তী নজরুল ইসলামের মতো প্রতিরোধে উতরোল নয় তাঁদের কবিতা। সমষ্টি চেতনাকে পেছনে ফেলে তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে ব্যক্তি মনন। প্রসঙ্গত কবি শঙ্খ ঘোষ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ঘটনাবলীকে দেখেছেন ব্যক্তিচোখ দিয়েই;যা তাকে স্বতন্ত্র করেছে।
এমারজেন্সি এর সময়ে, আকাশবানীতে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর দিন এবং অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন উপলক্ষে ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন’ শীর্ষক প্রযোজক শঙ্খ ঘোষকে একটি লাইন বদলে দেওয়ার অনুরোধ করেন। অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে তাঁর প্রতিবাদ করেছিলেন কবি। দেশ যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন ব্যতিক্রমী কবির কলম গর্জে উঠেছিল , “এ কোন দেশ?” আবার কোচবিহারে খাদ্য-আন্দোলনের মিছিলের ওপর পুলিশের গুলি চালনার, কিশোরী হত্যার প্রতিবাদে শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন
“নিভন্ত এই চুল্লিতে তবে
একটু আগুন দে।
হাতের শিরায় শিখার মতন
মরার আনন্দে।”
বস্তুত শঙ্খ ঘোষের এই প্রতিবাদী সত্ত্বা দেখা গিয়েছিল তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থেই। তারপর হাজার রক্তচক্ষুর ভিড়ে দমে যাননি কবি, বরং আরো দৃপ্ত হয়েছে তাঁর কন্ঠ। ‘জয়োৎসব ১৯৭২’, ‘তিমির বিষয়ে দু-টুকরো’ থেকে ‘ইন্দ্র ধরেছে কুলিশ’, ‘হাসপাতালে বলির বাজনা’, ‘মার্চিং সং’, ‘রাধাচূড়া’, ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ’, ‘শৃঙ্খলা’, ‘বাবু বলেন’ সর্বত্রই কবির অনমনীয় শিরদাঁড়ার পরিচয় বর্তমান। পরিস্থিতির কাছে নতি স্বীকার নয় বরং বিপরীত পরিস্থিতিতে কবি রূপক-স্নিগ্ধ ভাষায় লেখেন
খুব্ যদি ঝাড়ু বেড়ে ওঠে
দাও ছেঁটে দাও সব মাথা
কিছুতে কোরো না সীমাছাড়া
থেকে যাবে ঠিক ঠান্ডা, চুপ –
ঘরেরও দিব্যি শোভা হবে
লোকেও বলবে রাধাচূড়া
সুবিধেবাদী কবি সাহিত্যিকরা যখন রাজ্য ও শাসকদলের স্তাবক হয়ে নিজেদের কলম নামিয়ে রেখেছন। তখন স্রোতের বিপরীতে গিয়ে কলম ধরেন শঙ্খ ঘোষ। ক্ষমতার শেষ লগ্নে যখন বামফ্রন্ট সরকার স্বেচ্ছাচারী তখন কবি প্রতিবাদে লেখেন,
তিন রাউন্ড গুলি খেলে তেইশজন মরে যায়
লোকে এত বজ্জাত হয়েছে।
… … …
পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা আমার পুলিশ।
আবার সরকার বদলে তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় এলেও তাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম নামিয়ে রাখেন নি শঙ্খ ঘোষ। বরং পুলিশি অত্যাচার থেকে রাষ্ট্রীয়সন্ত্রাস, তার কবিতায় বার বার প্রতিফলিত হয়েছে প্রতিবাদী সত্ত্বা। বস্তুত ক্ষমতার কাছে আত্মসমর্পণ নয়, বরং ক্ষমতাতন্ত্রবিরোধী স্বরায়ণই কবির কাব্যজগত। কবির জন্মদিনে সঠিক ভাবে উত্তরকালের কবি শ্রীজাত তাকে মূল্যায়ন করেন ‘গাছ’ হিসাবে
কে বলে, গাছ শীর্ণ হল? আজও পাতায় সাহস বোনে,
শিকড় তাকে ক্ষমতা দেয়, নতুন নতুন বিষধারণের।
সপ্তাহান্তে আমরা যে যাই, যে-যার বিষাদ নামিয়ে আসি,
সেই দিয়ে তাঁর মাসকাবারি। সমগ্র। তাই স্বল্পভাষী।
কে বলে, গাছ ন্যুব্জ হল? আজও পাখির ডাক শোনা যায়
ইতিহাসের বয়স বাড়ে, যন্ত্রণা তার উঠোন সাজায়।
হাত দু’খানা বাড়ান যখন, প্রবহমান শব্দশিরা
এর দু’ধারেই সভ্যতা হয়। একটু দূরে আলতামিরা।
ফসলজমির নকশা পাড়ে, শাল গায়ে তাঁর মাটির শরীর
শাবলক্ষত আড়াল থাকে। দৃষ্টি তবু দেশান্তরী’র।
কে বলে, গাছ ক্লান্ত হল? আজও বাতাস একই রকম
আমরা ঝড়ে আশ্রয় চাই। তাঁর শাখা নেয় আকাশজখম।
গাছ, তুমি তাই এমনি থেকো। কী চাইব আর, জন্মদিনে?
পথ হারালে আমরা যেন ফিরতে পারি রাস্তা চিনে…