বাংলা হান্ট ডেস্কঃ আরজি কর ধর্ষণ খুন কাণ্ডে (RG Kar Case) সঞ্জয় রায়কে আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দিয়েছে শিয়ালদহ আদালত। গত সোমবার এই রায় দিয়েছেন বিচারক অনির্বাণ দাস (Justice Anirban Das)। সেদিনও আদালতে দাঁড়িয়ে নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেন আরজি কর-দোষী। সেই সঙ্গেই ফের একবার তুলে ধরেন ‘রুদ্রাক্ষ তত্ত্ব’। আইনজ্ঞরা মনে করছেন, আরজি কর কাণ্ডের রুদ্ধদ্বার শুনানির সময় তদন্তে সংগৃহীত সকল তথ্যপ্রমাণ ও সাক্ষ্যের ভিত্তিতে সঞ্জয় (Sanjay Roy) যা যা দাবি করেছেন, সেটি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।
সঞ্জয়ের দাবিতে শিরোনামে পুলিশি ‘ষড়যন্ত্রে’র তত্ত্ব (RG Kar Case)!
জানা যাচ্ছে, বিচারকের সামনে বয়ান দেওয়ার সময় সঞ্জয় তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করেন। তাঁর শরীরের ক্ষতিচিহ্ন থেকে শুরু করে ঘটনাস্থলে উদ্ধার হওয়া তাঁর মাথার ছোট ছোট চুল, ব্লুটুথ হেডফোন, সবকিছুর বিষয়ে এক ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন তিনি। সঞ্জয় যা দাবি করেছেন, সেগুলি প্রমাণ না করা গেলেও, শিয়ালদহ আদালতের বিচারক অনির্বাণ দাস নিজেও কলকাতা পুলিশ ও সিবিআইয়ের তদন্ত নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে এনেছেন।
গত সোমবার আরজি কর কাণ্ডে (RG Kar Case) সঞ্জয়ের সাজা ঘোষণা করেছে নিম্ন আদালত। সেই সঙ্গেই তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের বেশ কিছু খুঁটিনাটি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন বিচারক। জানা যাচ্ছে, বাজেয়াপ্ত করা সামগ্রীতে সঞ্জয়ের আঙুলের ছাপের অভাব থেকে শুরু করে নানান ধোঁয়াশার চিহ্নের কথা বিচারক অনির্বাণ দাসের রায়ে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে বায়োলজিক্যাল প্রমাণ পাওয়া গেলেও, সামগ্রিকভাবে নির্যাতিতার দেহ থেকে যে নমুনা উদ্ধার হয়েছিল, সেখানে নানান গোলমেলে দিকের খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। এমনকি নমুনায় মিলেছে অন্য এক মহিলার অস্তিত্বের প্রমাণ। বিচারকের নজরে এমন বিভ্রান্তিকর দিকও এসেছে বলে খবর। এসবের মাঝেই সঞ্জয়ের বয়ানকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন আইনজ্ঞেরা।
মামলার বিচারপ্রক্রিয়া অনুসারে, ভারতীয় নাগরিক ন্যায় সংহিতার ৩৫১ ধারা অনুসারে সকল সাক্ষীর বয়ান লিপিবদ্ধ করার পর অভিযুক্তের আত্মপক্ষ সমর্থনের বয়ান নথিভুক্ত করেন বিচারক। আরজি কর ধর্ষণ খুনের মামলাতেও (RG Kar Case) এর ব্যতিক্রম হয়নি। অভিযুক্ত সঞ্জয় সহ ৫১ জন সাক্ষীর বয়ান নথিভুক্ত করেন বিচারক। সেখানেই সঞ্জয়ের বয়ান বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আরও পড়ুনঃ ‘কিছুই করেননি’! ফের ‘ক্ষুব্ধ’ কলকাতা হাইকোর্ট! বিরাট নির্দেশ দিয়ে দিলেন বিচারপতি! কোন মামলায়?
আদালতের নথি অনুযায়ী, বিচারকের ৩২ এবং ৩৩ নং প্রশ্নের উত্তরে সঞ্জয় জানিয়েছেন, গত ৯ আগস্ট রাতে লালবাজারের নিয়ে আসার পর তাঁর মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ এবং গলায় থাকা রুদ্রাক্ষের মালা কর্তব্যরত পুলিশ আধিকারিকরা নিয়ে নিয়েছিলেন। এরপর লক-আপে নিয়ে গিয়ে পোশাক খুলে তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়, ছিঁড়ে নেওয়া হয় মাথার চুল।
এদিকে কলকাতা পুলিশের (Kolkata Police) তরফ থেকে দাবি করা হয়েছিল, আরজি করের নির্যাতিতার দেহের পাশ থেকে ধৃত সঞ্জয়ের মাথার চুল উদ্ধার হয়েছে। কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে এই দাবিতেই তা জমা দেওয়া হয়। সঞ্জয় দাবি করেন, ১০ আগস্ট সকালে একজন আইপিএস কর্তা তাঁকে ধর্ষণ খুনের অভিযোগ স্বীকার করে নিতে বলেন। সেই সঙ্গেই আশ্বাস দেন, ‘পরে সবকিছু ম্যানেজ হয়ে যাবে’। তবে সঞ্জয় এই দোষ স্বীকার করতে রাজি ছিলেন না। এরপর তাঁকে কলকাতার তৎকালীন পুলিশ কমিশনার বিনীত গোয়েলের ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনিও সঞ্জয়কে একই কথা বলেন। তবে তিনি তখনও রাজি না হওয়ায় ফের এক দফা মারধর করা হয়। এরপর এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তার শরীরের ক্ষতচিহ্নের পরীক্ষা এবং ভিডিওগ্রাফি করা হয়। আদালতে এমনটাই দাবি করেছে সঞ্জয়।
নিজের শরীরের ক্ষতচিহ্নেরও ব্যাখ্যা দিয়েছেন সঞ্জয়। তিনি দাবি করেন, গত ৫ আগস্ট কলকাতা পুলিশের এএসআই অনুপ দত্তের সঙ্গে ক্লাইম্বিং প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। সেই সময় পড়ে গিয়ে শরীরের নানান জায়গায় চোট পান তিনি। পরবর্তীতে সেই ক্ষতচিহ্নই ধর্ষণজনিত বলেন দাবি করেন তদন্তকারীরা। এর পাশাপাশি ঘটনার রাতে চেস্ট মেডিসিনের চারতলার সেমিনার হলের আশেপাশে কেন ঘুরছিলেন সেটারও ব্যাখ্যা দেন সঞ্জয়।
তিনি দাবি করেন, পুলিশ ওয়েলফেয়ার কমিটির সদস্য অনুপ দত্তের নির্দেশ মতোই গত ৮ আগস্ট সন্ধ্যাবেলা একজন রোগীর দেখাশোনা করতে হাসপাতালে গিয়েছিলেন। জরুরি বিভাগের তিনতলা এবং চারতলায় ঘুরে সেই রোগীর বিষয়েই খোঁজ নিচ্ছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ওই রোগীর খোঁজ না পেয়ে চেস্ট মেডিসিনের মেল ওয়ার্ডের একটি ফাঁকা বেডে শুয়ে পড়েন। পরের দিন ভোরবেলা হেলমেট নিয়ে আরজি কর (RG Kar Case) ছেড়ে বেরিয়ে যান। কিন্তু তখন নিজের হেডফোন ওয়ার্ডে ফেলে যান। এদিকে সঞ্জয়ের গ্রেফতারির পর জানা গিয়েছিল, ব্লুটুথ হেডফোনের সূত্রেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
বিচারকের কাছে সঞ্জয়ের দাবি, তাঁকে ফাঁসানোর জন্য সকল ফরেন্সিক নমুনা প্লান্ট করা হয়েছিল। একইসঙ্গেউ ‘রুদ্রাক্ষ তত্ত্ব’ও তুলে ধরেন তিনি। দাবি করেন, তাঁর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল। ধস্তাধস্তির সময় সেটি ছিঁড়ে যেতে পারতো। এই বিষয়ে আরজি কর মামলার (RG Kar Case) তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের আইনজীবীরা বলেন, ‘হেফাজতে থাকাকালীন জেরার সময় সঞ্জয় এসব কথা বলেননি। আদালতে চার্জ গঠনের সময় এসব কথা বলতে শুরু করেন। সেই সময় তাঁর বক্তব্যের ভিত্তিতে তদন্ত করার কোনও সুযোগ ছিল না। শুধুমাত্র উচ্চ আদালতের নির্দেশ মতোই সঞ্জয়ের বক্তব্য যাচাই করতে পারে তদন্তকারী সংস্থা’।