পৃথ্বীশ দাসগুপ্ত : আমাদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা নেই যে ভারতে অবস্থিত প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যেরই একটি করে রাজ্য দিবস আছে। যেমন ১লা মে পালিত হয় “মহারাষ্ট্র দিবস”, ১ লা নভেম্বর কর্ণাটক দিবস ও ৩০ শে মার্চ রাজস্থান দিবস ইত্যাদি।
অথচ পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেই এতো বিড়ম্বনা কেন ? সমস্যা হল রাজনীতির কারবারিদের নিয়ে, যাদের কাছে দেশপ্রেম, স্বজাতিপ্রীতির থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল দলীয় লাইন। তবুও জাতির নিদ্রাভঙ্গ হয়না, চেতনার উন্মেষ ঘটেনা, পরিবর্তিত হয় কালের চাকা, ইতিহাস তার নয়া দাবী নিয়ে সম্মুখীন হয় নতুন সমাজের। এটি স্মরণে রাখা প্রয়োজন, পশ্চিমবঙ্গ সৃষ্টি হয়েছিল দেশভাগের সময়।
প্রতিবাদী, ধীশক্তিসম্পন্ন, তেজস্বী বাঙালীকে ধ্বংস করার জন্য উদ্যত হয়েছিল মহাশক্তিরা, উনিশশো শতকের গোঁড়া থেকেই ষড়যন্ত্রের জাল বুনেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। উন্নত চিন্তাশীল বাঙালিকে ধ্বংস করার জন্য ধর্মীয় হিংসার আগুনে আহুতি দিতে তৎকালীন সমগ্ৰ বঙ্গ ভূমিকে পাকিস্তানের সাথে জুড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল চক্রান্তের মূল লক্ষ্য। ৪০ র দশকে বাংলার মুসলিম লীগ সরকার দ্বারা আনা মহা বিতর্কিত সাম্প্রদায়িক পক্ষপাতদুষ্ট “Secondary Education Bill” এর বিরুদ্ধে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে হিন্দু সমাজের সংগ্রাম বাংলার রাজনৈতিক উত্তাপকে এক নয়া মাত্রা দিয়েছিল। আন্দোলন এতো গুরুতর হয়ে ওঠে যে জনাব আবু হোসেন সরকারের মতো ব্যক্তিও বলে ওঠেন যে এই bill শিক্ষাক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলে, “হিন্দুস্তান বা পাকিস্তান র পরিবর্তে চারিদিকে শুধু গোরস্থানই থাকবে।”
এরপরই ১৬ ই আগষ্ট ১৯৪৬ সালে “Direct Action Day” এর ঘোষণা, ১০ ই অক্টোবর কোজাগরী লক্ষী পূর্ণিমার রাত্রে গোলাম সারওয়ারের নেতৃত্বে নোয়াখালীর সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কাশেমের ফৌজ, যে অগ্নি নির্বাপিত করতে ছুটে আসতে হয়েছিল স্বয়ং গান্ধীজিকে। কলকাতার নাগরিক জীবন তখন একেবারে বিপর্যস্ত। টানা কারফিউ চলছে শহর জুড়ে। দাঙ্গার পিছনে ছিল সরকারী মদত।
1947-এর 20শে ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাটলি ঘোষণা করে দেন, 1948-এর জুন মাসের মধ্যে ইংরেজরা লোটাপত্র নিয়ে ভারত ছেড়ে চলে আসবে, আর 1947 সালের 3রা জুন মাউন্টব্যাটেন পাঞ্জাব ও বাংলাকে টুকরো করে ভারত বিভাজনের পরিকল্পনা ঘোষণা করে দেন৷ মাঝখানের এই সাড়ে তিন মাসের ঘটনাপ্রবাহ বহু নেতার বহুবিধ পরিকল্পনার ভিত্তিতে, নানাবিধ জল্পনা বইছিল ভারতের আকাশে।
এই সময় শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায় উদ্যোগে 1947 সালের এপ্রিল মাসের গোড়ায় তারকেশ্বরে ডাক দেওয়া হয় তিনদিন ব্যাপী এক বিশেষ অধিবেশনের, তাতে অবিভক্ত বাংলার হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলি থেকে অংশ গ্রহণ করেছিল প্রায় ৪০০ জন প্রতিনিধি, উপস্থিত জনতার সংখ্যা ছিল কম করে ৫০ হাজার৷ সেই সভার পৌরোহিত্য করেন হিন্দু মহাসভার তৎকালীন সভাপতি, প্রাক্তন CPIM নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের পিতা নির্মল চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়৷ সেই সভাতে দাঁড়িয়ে দ্ব্যার্থহীন ভাবে শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায় ঘোষণা করেন, বাঙালি হিন্দু প্রধান অঞ্চল গুলোকে একসাথে রাখতে হবে। সেই রূপরেখা তৈরি করার জন্য একটি কাউন্সিল গড়ার সিদ্ধান্ত হয়, যার দায়িত্বও বর্তায় শ্যামাপ্রসাদ মূখোপাধ্যায়ের কাঁধে, স্থির হয় এক লাখ স্বেচ্ছাসেবককে নিয়ে দাবি আদায়ে ময়দানে আন্দোলন সংগঠিত করা হবে৷
বাঙালি হিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় এমন একটি দাবি অবশ্য অন্য কেউ করেননি৷ পাশাপাশি তৎকালীন বাংলার সাময়িকপত্রের নক্ষত্রেরা কলম ধরেন এই দাবির সমর্থনে৷তখন পত্র-পত্রিকার ওপরেও শুরু হয় দমনপীড়ন নীতি। এক বিশেষ অর্ডিন্যান্স বলে অমৃতবাজার পত্রিকা, হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড, আনন্দবাজার পত্রিকা, মডার্ন রিভিউ-এর ওপর ধার্য করা হয় জরিমানা। বাজেয়াপ্ত করা হয় জমা রাখা টাকা।
‘অর্চনা’ পত্রিকা তারকেশ্বর অধিবেশনের ওপর একটি পূর্ণাঙ্গ লেখা ছাপে। ‘মডার্ন রিভিউ’ ১৯৪৭ র মে মাসের কলমে মন্তব্য করে “দেশভাগ এখন একটা গৃহীত সত্য”। ডিসেম্বর মাসেই ‘প্রবসি লিখেছিল: বঙ্গ বিভাগের প্রস্তাব স্থিরভাবে বিচার করা প্রয়োজন হইয়াছে।’ সেই কথারই পুনরাবৃত্তি করে এখন ‘প্রবাসী’ ‘শনিবারের চিঠি’ পরিষ্কার লেখে: ‘পৃথক হইয়া যাওয়াই ভাল।’
পত্র-পত্রিকার প্রচারে হিন্দু মহাসভার দাবী প্রায় গণদাবীর চেহারা নেয়। গ্যালপ পোলের ভেতর দিয়ে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ প্রমাণ করে দেয়, পাঠকদের ৯৮% শতাংশই চায় ভারতের সাথে থাকতে। এই পরিকল্পনা কার্যকর করার জন্যে অমৃতবাজার পত্রিকা ‘বেঙ্গল পার্টিশন ফান্ড’ নামে একটা তহবিলই খুলে ছিল।
পশ্চিমবঙ্গের দাবী নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্য্যায় তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র ঘোষ, নলিনাক্ষ সান্যাল, পন্ডিত লক্ষীকান্ত মৈত্র, নীহারেন্দু দত্ত মজুমদার, মেজঃ জেনাঃ এসি চ্যাটার্জি, নলিনীরঞ্জন সরকার, যাদবেন্দ্রনাথ পাঁজা, ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডঃ মেঘনাদ সাহা, স্যার যদুনাথ সরকার, ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ মাখলাল রায়চৌধুরী, অমৃতবাজার-যুগান্তর পত্রিকা গোষ্ঠী, আনন্দবাজার পত্রিকা, দৈনিক বসুমতি, Modern Review ও প্রবাসী গোষ্ঠী, ডঃ রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, ডঃ বিনয় সরকার প্রমুখ ব্যক্তিগণ।
এমতাবস্থায়, ২০শে জুন, ১৯৪৭ অখণ্ড বাংলার হিন্দু প্রধান অঞ্চলের সদস্যরা পৃথকভাবে বসেন। হিন্দু মহাসভা সঙ্গে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট প্রতিনিধিরা বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ভোট দেয় এবং পক্ষে সর্বমোট ভোট পড়ে ৫৮টি। মুসলিম লীগ বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের বিরোধী হিসেবে ভোট দেয় দলবদ্ধভাবে, তাদের পক্ষে ভোট পড়ে ২১টি। ৫৮-২১ ভোটে বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব গৃহীত হয়ে। সৃষ্টি হয় পশ্চিমবঙ্গের।