‘KK আমার শত্রু, অসহ্য লাগে ওঁর গান!” গায়কের মৃত্যুতে কলম ধরলেন কবি শ্রীজাত

বাংলা হান্ট ডেস্কঃ কেকে (KK) নামটা শুনলেই ফিরে যেতে হয় নব্বই দশকের নস্টালজিয়ায়। ‘হম দিল দে চুকে সানাম’ থেকে ‘ইয়ারো দোস্তি’ গানের মাধ্যমে সেই সময় ঢুকে পড়েছিলেন সমগ্র দেশবাসীর হৃদয়ে। এরপর দীর্ঘ ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে একের পর এক জেনারেশনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গানের মাধ্যমে সকলকে সম্মোহিত করে চলেছিলেন এই গায়ক।

তবে সব মায়া কাটিয়ে মঙ্গলবার রাতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কেকে। বর্তমানে তাঁর মৃত্যু কোনোভাবেই যেন মেনে নিতে পারছে না কেউই। আবারো গায়কের কণ্ঠে সম্মোহিত গান শোনার অপেক্ষায় অশ্রু ঝরিয়ে চলেছে সকল দেশবাসী আর এর মাঝেই প্রয়াত সংগীত শিল্পীকে নিয়ে নিজের ইমোশান প্রকাশ করে একটি ফেসবুক পোস্ট করলেন কবি, গীতিকার এবং পরিচালক শ্রীজাত। লম্বা ফেসবুক পোস্টের প্রথমেই তিনি লেখেন, “দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে আমি কেকের গান শুনিনি, আমার অসহ্য লাগে।” যদিও পরবর্তীতে সেই কারণও ব্যাখ্যা করেন তিনি।

   

ফেসবুক পোস্টে শ্রীজাত লেখেন, “KK-র গান আমার অসহ্য লাগে। গত ১৬ বছর ধরে অসহ্য লাগে। সেই ২০০৬-এর ডিসেম্বর থেকে আজ অবধি KK-র গান আমি সহ্য করতে পারি না। ক্যাব-এর রেডিও-তে হঠাৎ বেজে উঠলে চালককে তৎক্ষণাৎ বলি চ্যানেল সরিয়ে দিতে, কোনও জমায়েতে হুট করে বেজে উঠলে সন্তর্পণে উঠে বাইরে চলে যাই। এতটাই অসহনীয় আমার কাছে, KK-র গান, গত ১৬ বছর ধরে। টানা ১৬ বছর, আমি KK-র গান শুনিনি। সত্যি বলতে কী, পালিয়েছি তাঁর কাছ থেকে।”

যদিও এরপর রহস্যের উন্মোচন করে তিনি লেখেন, “আসলে তাঁর কাছ থেকে নয়, পালিয়েছি আমার অকাল প্রয়াত ভাইয়ের কাছ থেকে। ব্যক্তিগত ক্ষয়ের কথা, আন্তরিক ক্ষরণের কথা সমক্ষে তুলে ধরিনি কখনওই, জীবনের প্রতি সংকোচ আর স্মৃতির প্রতি সম্ভ্রম থেকেই। কিন্তু কিছু আকস্মিকতায় সেসব বাঁধ, সেসব আড়ালও হয়তো টুটে যায় সাময়িক ভাবে। ছোট ভাই, যার আদরের নাম পুশকিন, তার প্রিয় গায়ক ছিলেন KK। আর তার হাত ধরে আমারও। গিটারে তার হাত চলাফেরা করত চমৎকার, আর সুরে গলাও খেলত দিব্যি। তার পড়াশোনা আর পরীক্ষার চাপের ফাঁকে ফাঁকে আমি তাকে জোর করে বসাতাম, ‘গান শোনা দেখি দু’খানা’। এমন বললে সে দু;খানা গানই গেয়ে উঠত কেবল। ‘ইয়ারোঁ, দোস্তি বড়ি হি হসীন হ্যায়’, আর ‘হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’।”

এরপর কবি জানান, এক বাইক দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়ে তাঁর আদরের ভাই ‘পুশকিন’। চাইলেও সেই সময় তিনি তাকে বাঁচাতে পারেননি আর এরপর থেকেই একপ্রকার শোনা বন্ধ করে দেন kk-র গান। সেই স্মৃতির সরণী বেয়ে তিনি লেখেন, “সাড়া দেবে না আমাদের কারও ডাকে, গিটারের তার থেকে আঙুলের মায়া ছাড়িয়ে নিয়ে দশ দিনের মাথায় হাজির হবে গনগনে আগুনের সামনে, শরীরের নির্জীব সাক্ষী দিতে। সেই থেকে KK আমার শত্রু, সেই থেকে এই গানগুলো আমার দু’চোখের বিষ। সেই থেকে আমি KK-র অসামান্য সুরেলা আর টানটান দরাজ কণ্ঠ থেকে পালিয়ে বেড়াই, কোনো অনুষ্ঠানে তিনি মাইক হাতে নিলেই আমি উঠে চলে আসি, কখনও পিকনিকের দুপুরে তাঁর গান বাজানো হলে আমার বাড়ি যাবার তাড়া চলে আসে। কেউ জানে না, কিন্তু ১৬ বছর ধরে এই একজন মানুষের গানের কাছ থেকে পালাই আমি। পিঠ বাঁচিয়ে, মন বাঁচিয়ে, চোখ বাঁচিয়ে।”

উল্লেখ্য, পুশকিনের মতোই গতকাল চিরনিদ্রায় শায়িত হন কেকে, যার গানের প্রতি এতদিন একপ্রকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন শ্রীজাত। সেই প্রসঙ্গে কবি লেখেন, “আজ তিনি চলে গেলেন, যাবার মুহূর্তের কিছু আগেও গানই তাঁর সঙ্গ দিলো। কী গেয়েছিলেন, জানি না। KK আসছেন শুনেই নজরুল মঞ্চের কাছাকাছি দিয়ে যাতায়াতের পথ বাছিনি আজ। কে বলতে পারে, যদি ‘ইয়ারোঁ, দোস্তি…’-র এক কলিও কানে ঢুকে আসে? পালিয়েছি আজও। কেবল বুঝিনি, তাঁরও পালানোর মতলব আছে, পুশকিনের মতোই। রাগ ছিল লোকটার উপর খুব। কখনও দেখা হলে কেঁদেকেটে ঝগড়া করার ছিল অনেকখানি। জড়িয়ে ধরবারও লোভ ছিল খুব, অভিমানে, অসহায়তায়। সেসব গানের সঙ্গেই ভেসে গেল।”

শ্রীজাতর সংযোজন, “হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল গানের কথাকে একজীবনে এমন অসহ সত্যি করে দিয়ে চলে যাবার মতো মানুষ কমই আসেন পৃথিবীতে। KK তাঁদেরই একজন। ১৬ বছরের গভীর ক্ষতের উপর মলমের বদলে মশাল চেপে ধরলেন তিনি। এমনই মশাল, যার আগুনে দূরে কোথাও পুশকিনের গিটারটাও পুড়ে যাচ্ছে, একা একা।”

Avatar
Sayan Das

সম্পর্কিত খবর