রোজগার ছিল মাত্র ১৫০ টাকা! স্ত্রী’র উৎসাহে হাজার কোটি টাকার কোম্পানির মালিক ওধবজি প্যাটেল

বাংলা হান্ট ডেস্ক: রোজকার জীবনযাপনে আমরা আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলির তালিকায় এমন কিছু ব্র্যান্ডের জিনিস ব্যবহার করি, যা শুধুমাত্র অঞ্চল বিভেদে নয়, পাশাপাশি, সামগ্রিক দেশজুড়েও তার ব্যাপ্তি থাকে। সেই সমস্ত কোম্পানির জিনিসগুলিকে আমরা চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারি। ঠিক সেইরকমই এক কোম্পানির কথা আমরা তুলে ধরবো বর্তমান প্রতিবেদনে।

অবশ্যই আমরা কোনো না কোনো সময়ে অজন্তা, অরপেট বা ওরেভা কোম্পানি থেকে কিছু না কিছু ব্যবহার করেছি, যেগুলি দেশের বিশ্বস্ত ব্র্যান্ডগুলির মধ্যে অন্যতম। কিন্তু, এই স্বনামধন্য ব্র্যান্ডগুলির নেপথ্যে যিনি রয়েছেন সেই ওধবজি প্যাটেলের সংগ্রাম থেকে সাফল্যের কাহিনি আমরা অনেকেই জানিনা। এই প্রতিবেদনে আমরা জানবো এক চূড়ান্ত সফল ভারতীয়র কথা।

   

ওধবজি প্যাটেল পেশায় একজন শিক্ষক ছিলেন, যিনি তাঁর পরিবারের অতিরিক্ত খরচ মেটাতে ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসায়িক কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড ছাড়াই ওধবজি একটি বা দুটি নয়, মোট তিনটি ব্র্যান্ডের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

ওধবজি প্যাটেল, তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ১৯২৫ সালের ২৪ জুন গুজরাটের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বাড়িতে কৃষিকাজের প্রচলন থাকলেও ওধবজি তাঁর বাবার সাথে কৃষিকাজ না করে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজ্ঞানে স্নাতক হন এবং বিএড ডিগ্রি লাভ করেন। তারপরেই তিনি ভিসি স্কুলে বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হিসাবে তিন বছর ধরে শিক্ষকতা করেছিলেন।

শিক্ষকতার মাধ্যমে ওধবজি প্রতি মাসে ১৫০ টাকা বেতন পান। কিন্তু এত অল্প টাকায় তাঁর পক্ষে পরিবারের খরচ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। পাশাপাশি, তাঁর সন্তানরা বড় হয়ে যাওয়ায় তাদের সুশিক্ষা ও লালন-পালনের জন্য বাড়িতে আর্থিক চাপও বাড়তে থাকে। দিনের পর দিন বাড়ির এমন খারাপ আর্থিক অবস্থা দেখে ওধবজির স্ত্রী খুব ভেঙে পড়েন এবং তিনি পরামর্শ দেন যে, স্কুল থেকে আসার পর বাকি সময়ে যদি কোনো ব্যবসা শুরু করা হয় তবে খুব ভালো হয়!

ওধবজি প্যাটেল তাঁর স্ত্রী’র পরামর্শে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু তাঁর সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল সঠিক ব্যবসাকে বেছে নেওয়া। এরপরে, অনেক ভেবে-চিন্তে, ওধবজি মোরবি শহরে একটি কাপড়ের দোকান খুলেছিলেন, যেখান থেকে বেশ ভালো আয় করেছিলেন তিনি।

ওধবজির এই কাপড়ের দোকান ১৯৭০ সাল পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ছিল। তারপরে তিনি অন্য ব্যবসায় অর্থ এবং সময় বিনিয়োগ করতে শুরু করেন। এদিকে, ১৯৬০-এর দশকে, গুজরাট সহ ভারতের অনেক রাজ্যে ভূগর্ভস্থ জল কমতে শুরু করে। যার কারণে জল তোলার জন্য মেশিন ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়।

পাশাপাশি, মেশিন চালানোর জন্য ইঞ্জিন তেলেরও প্রয়োজন হয়। যদিও গুজরাটের প্রায় সব গ্রামেই কূপ ছিল, কিন্তু সেগুলিতে জলের উপস্থিতি ছিল খুবই কম। এমন পরিস্থিতিতে, ওধবজি এই এলাকায় ব্যবসার সম্ভাবনা আছে বুঝতে পেরে বসন্ত ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কসের সাথে যুক্ত হয়ে তেল তৈরির কাজ শুরু করেন।

ওধবজি তাঁর মেয়ের নামে এই ব্যবসা শুরু করেন এবং কোম্পানির নাম দেন “জয়শ্রী”। এই ইউনিটটি প্রায় ৫ বছর ধরে চলতে থাকে। তারপরে বেশ কয়েকজন ওধবজিকে ট্রানজিস্টার ঘড়ি তৈরি করার পরামর্শ দেন। ওধবজির এই ধারণাটি এতটাই পছন্দ হয়েছিল যে, তিনি অবিলম্বে ট্রানজিস্টর ঘড়ি তৈরি করতে শুরু করেছিলেন।

এর জন্য ওধবজি একটি বাড়ি ভাড়া নেন, যার ভাড়া ছিল প্রতি মাসে ৬০০ টাকা। সেই বাড়িটিকে ঘড়ি তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত করে ১,৬৫,০০০ টাকা দিয়ে ট্রানজিস্টর ঘড়ির প্রথম সেটটি তৈরি করেন তিনি। ওধবজি এই ঘড়ির ব্র্যান্ডের নাম দেন অজন্তা, যা শীঘ্রই সারা ভারতে বিখ্যাত হয়ে ওঠে।

download news

উল্লেখ্য যে, ওধবজি প্রতিটি ব্যবসাতেই যে সফল হয়েছেন তা কিন্তু নয়। কারণ অজন্তা শুরু করার সময়ে অন্যান্য ব্যবসায় তাঁকে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, ওধবজি অজন্তা কোম্পানি বন্ধ করার পরিবর্তে এটি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নেন। তিনি অজন্তা ব্র্যান্ডের অধীনে ঘড়ি তৈরির কাজ চালিয়ে যান।

ধীরে ধীরে মানুষ তাঁর এই ব্র্যান্ডে বিশ্বাস করতে শুরু করেন। শুধু তাই নয়, সময়ের সাথে সাথে অজন্তা ভারতীয় বাজারে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বিশ্বস্ত ব্র্যান্ড হিসেবে পথ চলা শুরু করে। এর সাথে সাথে, অজন্তা গুজরাট থেকে বেরিয়ে অন্যান্য রাজ্যেও তার বাজারকে শক্তিশালী করেছিল।

মাত্র দেড় লক্ষ টাকা খরচ করে ঘড়ি তৈরির কাজ শুরু করে অজন্তা কোম্পানির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ওধবজি প্যাটেল। আর আজ ভারতের ১০০০ কোটি টাকা মুনাফা করা কোম্পানির তালিকায় অজন্তার নাম রয়েছে। অজন্তার সাথে, ওধবজি ওরেভারও ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

এছাড়াও, তিনি অরপাট নামের একটি ব্র্যান্ডও শুরু করেছিলেন, যা ভারতের বিশ্বস্ত হোম অ্যাপ্লায়েন্স কোম্পানি হিসাবে পরিচিত। ভারতের এহেন সফল ব্যবসায়ী ৮৭ বছর বয়সে ২০১২ সালের ১৮ অক্টোবর, না ফেরার দেশে পাড়ি দেন। তাঁর সাজিয়ে যাওয়া ব্যবসাটি বর্তমানে তাঁর সন্তানরা পরিচালনা করেন। স্বভাবতই, ওধবজি প্যাটেলের সংগ্রাম এবং সাফল্যের গল্প শত শত মানুষকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে।

Sayak Panda
Sayak Panda

সায়ক পন্ডা, মেদিনীপুর কলেজ (অটোনমাস) থেকে মাস কমিউনিকেশন এবং সাংবাদিকতার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করার পর শুরু নিয়মিত লেখালেখি। ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা হান্ট-এর কনটেন্ট রাইটার হিসেবে নিযুক্ত।

সম্পর্কিত খবর