বাংলাহান্ট ডেস্ক: বাংলাদেশি লেখিকা তসলিমা নাসরিন। বিতর্কিত লেখার জন্য নির্বাসিত বাংলাদেশ থেকে। এই একই কারনে তাঁকে ছাড়তে হয়েছে কোলকাতা। বর্তমানে দিল্লিবাসী তিনি। তসলিমাকে সবাই নারীবাদী লেখিকা হিসেবেই জানেন। নিজে মুসলিম হলেও থাকেননি পর্দার আড়ালে। সবসময় তিনি নারীদের অগ্রাধিকার নিয়ে কথা বলেছেন। পড়ে নিন কী বলেছেন তিনি।
“আমেরিকার কুখ্যাত সিরিয়াল কিলার টেড বাণ্ডিকে নিয়ে তৈরি নতুন একটি পূর্ণদৈর্ঘ ছবি নেটফ্লিক্সে সবে এসেছে। ছবির নাম ‘এক্সট্রিমলি উইকেড শকিংলি ইভল এন্ড ভাইল’। টেড বাণ্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের ছাত্র ছিল। সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন শহরের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অল্প বয়সী সুন্দরী মেয়েদের সে অপহরণ করতো, ধর্ষণ করতো, তারপর খুন করতো। প্রথম দিকে নিরপরাধ সাজার বহু চেষ্টা করেছে কিন্তু এক সময় উপায় না দেখে তিরিশটি খুনের কথা সে স্বীকার করেছে। গবেষকরা অবশ্য মনে করেন, টেড ৩০-এর বেশি খুন করেছে, সম্ভবত ১০০ বা ১০০র চেয়েও বেশি। টেড বান্ডি এতই সুদর্শন সুপুরুষ ছিল, চলনে বলনে এমনই স্মার্ট ছিল যে মেয়েরা খুব সহজে মুগ্ধ হতো তাকে দেখে। এত হাসিখুশি চমৎকার তার ব্যবহার ছিল যে তাকে যারা চিনতো ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারতো না যে এই লোক কাউকে খুন করতে পারে। টেডকে গ্রেফতার করাও সহজে সম্ভব হয়নি। দুবার দুটো জেল থেকে পালিয়েছিল । কিন্তু একদিন ঠিকই সে ধরা পড়ে। মৃত্যুদণ্ড হয় তার। অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলেছে, টেড বাণ্ডি কীকরে মেয়েদের অপহরণ করতো, কী করে তাদের হত্যা করতো। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তরই মানুষ পায়নি, হত্যা করার নেশাই যখন টেডের ছিল, টেড কেন বেছে বেছে শুধু মেয়েদেরই হত্যা করতো? কেন কুকর, শুকর, পাখি, পুরুষ ইত্যাদিকে হত্যা করতো না? ধর্ষণই মূল উদ্দেশ্য ছিল টেডের এমন মনে হয় না, অনেক মেয়েকে, দেখা গেছে, ধর্ষণ করেনি, কিন্তু খুন করেছে।
যে সময় টেড বাণ্ডি খুন করছে মেয়েদের, সে সময় হিলসাইড স্ট্র্যাংগ্লার নামে কুখ্যাত আরো দুই খুনির আবির্ভাব হয়েছে, তাদের নাম ছিল কেনেথ বিয়াঞ্চি আর এঞ্জেলো বুওনো। তারাও কিশোরী আর যুবতীদের অপহরণ করতো, তারপর ধর্ষণ করতো, অবশেষে খুন। টেড বাণ্ডি খুন করতো ওয়াশিংটুন, ইউটা, ফ্লোরিডা রাজ্যে। আর হিলসাইড স্ট্র্যাংগ্লার খুন করতো ক্যালিফোর্নিয়া অঞ্চলে। কোনও অঞ্চলেই কি নারীহত্যা কোনওকালে বন্ধ হয়েছে? মাত্র কয়েক বছর আগেই তো, ২০১৪ সালে, ক্যালিফোর্নিয়ার এলিয়ট রজার বন্দুক হাতে রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল যে মেয়েকেই সামনে পায় তাকেই খুন করবে বলে। এলিয়টের নারীবিদ্বেষ এত প্রচণ্ড ছিল যে ইউটিউবে মেয়েদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঘৃণার একটি ভিডিও পোস্ট করেছিল । ভিডিওতে বলেছিল, সে এখনও ভার্জিন, কারণ এ পর্যন্ত একটি মেয়েও তার সংগে সেক্স করতে চায়নি। মেয়েদের বিরুদ্ধে ঘৃণা আর রাগ প্রকাশ ক’রে ১৪০ পৃষ্ঠার একটি মেনিফেস্টোও সে লিখেছিল। ছ’ জনকে খুন করেছিল এলিয়ট। এই খুনের পর, আশ্চর্য, এলিয়টের নিন্দে তো নয়ই , রীতিমত তার প্রশংসা শুরু হয়ে গেল। এদিক ওদিক থেকে তার ভক্ত বেরোতে লাগলো। নারীবিদ্বেষী ভক্তদের সে কী উচ্ছাস! এলিয়টের নাম তারা দিয়েছিল ‘সুপ্রীম জেন্টলম্যান’। টিশার্টে এলিয়টের ছবি ছাপিয়ে পরতো। কানাডার অ্যালেক মিনাসিয়ান এলিয়ট রজারকে গুরু মেনে একদিন এলোপাথারি ভ্যান চালিয়ে দিয়েছিল টরোন্টোর ব্যস্ত রাস্তায়। ১০ জন পথচারীকে হত্যা করেছে, যাদের বেশির ভাগই মেয়ে।
অফলাইনে তো বটেই, অনলাইনেও ইদানীং হাজারো রকম নারীবিদ্বেষী সংগঠন গড়ে উঠেছে, তার দু’একটির নাম — ‘মেন’স রাইটস’, ‘ইনসেল রেবেলিয়ন’, ‘পিক আপ আর্টিস্ট’ । পিক আপ আর্টিস্ট সংগঠনটির বক্তব্য, মেয়েদের বশ করে তারপর সেক্স করাই ভালো। তারা নারীবিদ্বেষী হলেও মিনাসিয়ানের মতো নারীবিদ্বেষী নয়। মিনাসিয়ান খুন খারাবিতে বিশ্বাসী। পিক আপ আর্টিস্টরা ওতে বিশ্বাসী নয়, কিন্তু ধর্ষণে বিশ্বাসী, তারা মনে করে ধর্ষণ করার অধিকার প্রতিটি পুরুষের থাকা উচিত।
এলিয়ট রজার প্রথম নয়, তার আগে, ২০০৯ সালে জর্জ সডিনি নামে এক নারীবিদ্বেষী পেনসিলভেনিয়ার একটি জিমে ঢুকে তিনটে মেয়েকে খুন করেছিল। খুনের আগে অনলাইন ডায়রিতে লিখেছিল, তার সেক্স করা হয়নি অনেক বছর, কারণ মেয়েরা তাকে অবজ্ঞা করে।
পুরুষগুলোকে কে শেখাবে যে তাদের যৌনতৃষ্ণা জাগলেই তা মেটাবার দায়িত্ব মেয়েদের ওপর বর্তায় না? পুরুষগুলোকে কে শেখাবে যে তারা যদি মনে করে তারা পুরুষ বলেই তাদের অবিবেচক হওয়ার, অসহিষ্ণু হওয়ার, হিংস্র হওয়ার, নিষ্ঠুর হওয়ার, বর্বর হওয়ার সব রকম অধিকার আছে – তাহলে তারা ভয়ংকর ভুল করছে।
নারীবিদ্বেষীরা হত্যাযজ্ঞ ঘটাচ্ছে জেনেও সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষজ্ঞরা ‘লোন উলফ’ হত্যা করছে বলে রায় দিচ্ছেন। লোন উলফের আক্ষরিক অর্থ ‘একলা নেকড়ে’। লোন উলফদের হামলার কোনও নির্দিষ্ট নকশা থাকে না, উদ্দেশ্যবিহীনভাবে মানুষ খুন করার পেছনে মাদকে আসক্তি, চরম হতাশা, অসুখী শৈশব এরকম নানা কারণ দেখানো হয়। কিন্তু যারা মেয়েদের প্রতি ঘৃণার তীব্রতায় মেয়েদের খুন করে, ঠান্ডা মাথায় খুন করে, তারা আর যাই হোক, লোন উলফ নয়। নারীবিদ্বেষী সন্ত্রাসীদর সংগে একমাত্র ধর্মীয় সন্ত্রাসীদের তুলনা চলে। ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা চায় তাদের ধর্মের নিন্দে যারা করছে, তারা সবাই মরে যাক। নারীবিদ্বেষী সন্ত্রাসীরাও চায়, সব নারী মরে যাক। পুরুষের পায়ের তলায় কোনও নারী যদি দাসি হয়ে থাকতে চায়, বেঁচে থাকতে পারে, তা ছাড়া কোনও নারীরই বাঁচার অধিকার নেই। নারীবিদ্বেষী সন্ত্রাসীরা আর যাই হোক, লোন উলফ নয়, মানসিক রোগী নয়, তারা মদ পান ক’রে, বা মাদক সেবন ক’রে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে না। তারা নারীর প্রতি ঘৃণা থেকে হত্যাকাণ্ড ঘটাচ্ছে। এই হত্যাকাণ্ডের একটি উদ্দেশ্য আছে। এই হত্যা পরিকল্পিত হত্যা। এই হত্যা রাজনৈতিক।
মার্ক লেপিনকে মনে আছে? ১৯৮৯ -এ কানাডার মন্ট্রিয়ালে পলিটেকনিক্যাল স্কুলে ঢুকে ছাত্রদের সরিয়ে দিয়ে শুধু ছাত্রীদের খুন করেছিল? ক্লাসরুমের মোট ১৪ জন ছাত্রী খুন হয়েছিল সেদিন । সত্তর আর আশির দশকে চার্লস সবরাজ, যাকে বিকিনি কিলার বলেও ডাকা হতো, থাইল্যান্ডে আর নেপালে কম মেয়েকে খুন করেছে! ইয়র্ক শায়ার রিপার পিটার সাটক্লিফ ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত ১৩ জন মেয়েকে খুন করেছে, তাছাড়া প্রচুর মেয়েকেই চেষ্টা করেছে খুন করতে। অস্ট্রেলিয়ার ক্রিস্টোফার ওয়াইল্ডার ১২ জন মেয়েকে হত্যা করেছে। আমেরিকার রোডনি আল্কালা, কার্ল ইউজিন ওয়াটস, লিওনার্ড লেক, জেরাল্ড স্টানো, কানাডার কীথ হান্টার জেস্পারসান সকলেই নারী-হত্যায় লিপ্ত ছিল। আর ক্লিভল্যাণ্ডের আরিয়েল ক্যাস্ট্রো! যে লোকটি তিনটে জলজ্যান্ত কিশোরীকে অপহরণ করে তার বাড়িতে শেকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিল ১০ বছরের চেয়েও বেশি, যৌনদাসি বানিয়েছিল ওদের, ধর্ষণ করতো আর নির্যাতন করতো!
নারী বিদ্বেষের প্রতিবাদ করতে গিয়ে কত নারীবাদীকে যে মৃত্যুর হুমকি পেতে হয়েছে। এই তথ্য -প্রযুক্তির যুগে নারীবিদ্বেষের প্রচার যেমন বেশি, নারীবাদীদের বিরুদ্ধে হুমকিও তেমন বেশি। অন্য যে কোনও সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ড এক সময় বন্ধ হতে পারে, কিন্তু নারীবিদ্বেষ থেকে উদ্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ হওয়া সম্ভব নয়, যেহেতু নারীবিদ্বেষকে স্বাভাবিক বলেই মনে করা হয় সমাজে। পুরুষতন্ত্রের সংগে অঙ্গাঙ্গী জড়িত নারীবিদ্বেষ। নারীবিদ্বেষ না থাকলে পুরুষতন্ত্র ধসে পড়বে। নারীবিদ্বেষকে সে কারণে দীর্ঘ দীর্ঘ কাল টিকিয়ে রাখছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
নারীবিদ্বেষ থাকলেই নারীকে পুরুষের চেয়ে সর্বক্ষত্রে অক্ষম বলে ভাবা হয়। ভাবা হয় পুরুষের তুলনায় নারীর বুদ্ধি কম, মেধা কম, শক্তি কম, দক্ষতা কম, সাহস কম, বীরত্ব কম, তাই পুরুষ নারীর ওপর ছড়ি ঘোরাবে। পুরুষ লক্ষণরেখা এঁকে দেবে নারীর জন্য, নারী কী পরবে, কী খাবে, কোথায় যাবে, কতটুকু যাবে, কী পড়বে, কী বলবে, কী লিখবে, কী ভাববে—সব কিছুর একটা সীমা থাকবে। নারীকে তুচ্ছ ভাবা, ক্ষুদ্র ভাবা নারীবিদ্বেষ না থাকলে সম্ভব নয়। নারীর প্রতি তীব্র ঘৃণার কারণেই আজও নারী নির্যাতন চলছে, যৌতুকের অত্যাচার চলছে, , ঘরে বাইরে সর্বত্র যৌন হেনস্থা চলছে, ধর্ষণের জন্য ফাঁসির ঘোষণা দিয়েও ধর্ষণ বন্ধ করা যাচ্ছে না কোথাও, নারীহত্যাও বহাল তবিয়তে চলছে। সম্মান রক্ষা করার নামে, ব্যভিচারের বিচারের নামে নারীহত্যা চলছেই।
নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দেখতে দেখতে বেড়ে ওঠা শিশুরা নারী-পুরুষের সমানাধিকার সম্পর্কে কোনও শিক্ষা অর্জন করে না। তারা পরিবার এবং সমাজ থেকে যা শেখে, তা নির্জলা নারীবিদ্বেষ। যদি তুমি শিক্ষায়, দীক্ষায়,আইনে, আদালতে, রাষ্ট্রে, সমাজে, পরিবারে নারীর সমানাধিকার দাবি করো, তোমাকে একঘরে হতে হবে। প্রধান মন্ত্রী নারী, এর অর্থ কিন্তু এই নয় যে, সমাজে নারীবিদ্বেষ বা নারীর বিরুদ্ধে কোনও বৈষম্য নেই। বিরোধীদলের নেত্রী নারী, মন্ত্রী নারী, রাষ্ট্রনেত্রী নারী – এর মানে কিন্তু এই নয় যে, এদেশে পুরুষ যতটা স্বাধীনতা ভোগ করে, ততটা স্বাধীনতা নারীও ভোগ করে।
নারীরা বিভিন্ন কারণে খুন হয়। সব খুনই ‘নারীহত্যা’ নয়। যদি পুরুষেরা কোনও নারীকে যেহেতু সে নারী, খুন করে, তাহলে সেটি নারীহত্যা। পুরুষহত্যা নেই বললেই চলে সমাজে। পুরুষদের পুরুষ হওয়ার কারণে খুন হতে হয় না। সমাজে পুরুষ হওয়াটা গ্লানিময় নয়, গ্লানিময় নারী হওয়াটা। নারীরা তাদের খুনীর সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্টভাবে বাস করে। রীতিমত এক ছাদের তলায়। নারীর অধিকাংশ খুনীই নারীর কাছের লোক, স্বামী বা প্রেমিক বা বন্ধু বা নিকটাত্মীয়। মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রজাতির মধ্যে খুনীর সঙ্গে বসবাসের প্রবণতা নেই।”