বাংলা হান্ট ডেস্ক : ‘ভারত আমাদের ডাকছে, রক্ত দিয়ে রক্তকে ডাকছে, আর সময় নেই। অস্ত্র তোলো, ঈশ্বর চাইলে শহিদের মৃত্যু বরণ করে নেব আমরা।’ বক্তার নাম নেতাজি (Netaji) সুভাষ চন্দ্র বসু (Subhas Chandra Bose)। তাঁকে নিয়ে এমন কতগুলি ঘটনা আছে যেগুলো হয়তো সচারচর আলোচিত হয় না। আজ আমরা দেশমাতৃকার সেই বীর সন্তানের সম্পর্কে বেশ কয়েকটি অজানা কথাই তুলে ধরব।
আমরা সকলেই জানি এই নেতাজির জন্ম উড়িষ্যার (Odisha) কটকের কিন্তু অনেকেই এই কথাটা জানেন না তার আদি জন্মভিটা কিন্তু পশ্চিমবাংলাতেই। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার কোদালিয়া গ্রামে তাদের আদি বাড়ি ছিল। যদিও এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, কোদালিয়া নামটার সঙ্গে অনেকে পরিচিত না হলেও যারা নিয়মিত শিয়ালদা থেকে সাউথের লোকাল ট্রেন ধরেন তারা কমবেশি সবাই ‘সুভাষগ্রাম’ চেনেন।
নেতাজি অবশ্য তার ছোটবেলার বেশ খানিকটা সময় কোদালিয়াতে থেকেছেন। এমনকি দূর্গা পূজার সময় এলগিন রোডের বাড়ি থেকে গোটা বসু পরিবারেরই আগমন হতো কোদালিয়াতেই। মান্দালয় সেন্ট্রাল জেলে থাকার সময় নেতাজি তার সেই বাড়িতে কাটানো ছোটবেলার পুজোর কথা তুলে ধরে দাদা শরৎচন্দ্র বসুকে চিঠিও পাঠিয়েছিলেন।
এবার আসা যাক সুভাষচন্দ্র বসুর খাওয়া-দাওয়ার কথায়। আক্ষরিক অর্থে ‘পেটুক’ না বললেও দেশের এই বীর সন্তান ‘তেলেভাজা’ বলতে অজ্ঞান ছিলেন। মুগ ডালের খিচুড়ি তার এতটাই প্রিয় ছিল যে তার দীক্ষাগুরু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে গেলেই দেশবন্ধু স্ত্রীর হাতে তার খিচুড়ি খাওয়া চাই-ই চাই। শুধু তাই নয় স্কটিশ চার্চ কলেজের দিনগুলোতে প্রায় ঢুঁ দিতেন উত্তর কলকাতার বিখ্যাত চপের দোকান লক্ষ্মীনারায়ণ সাউয়ের ওখানেও। তবে দেশের কাজ করার সময় যাতে শারীরিক ভাবে বেগ পেতে না হয় তার জন্য সব সময়ই খাদ্যতালিকার দিকে বিশেষ নজর দিতেন।
আর দেশমাতৃকার সেবায় তার জীবনের পরম ধর্ম ছিল বলেই তো বেছে নিয়েছিলেন মহানিষ্ক্রমনের পথ। তবে, এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, ইংরেজদের চোখে ধুলো দিয়ে সেই রাতে নেতাজির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা আমরা সবাই জানলেও অনেকেই জানেন না সেই রাতে ঘরের মধ্যে হুবহু ‘নেতাজি’ সেজে বসেছিলেন একজন মহিলা। অবাক লাগল এ কথা সত্যি যে তিনি ছিলেন নেতাজির ভাইঝি ইলা বসু।
সেদিন রাত ১.৩৫ নাগাদ মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশ ধরে নেতাজি পালিয়ে যাওয়ার সময়ের নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি এলাকা ছেড়ে বেরলেই যেন তার ঘরের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়। সেই কথাকেই শিরোধার্য করে ইলাদেবী শুধু যে প্রায় ঘন্টা দেড়েক নেতাজি সেজে বসেছিলেন তাই নয়, এমনকি সন্দেহ এড়াতে দিন দশেক নেতাজির ঘরে খাবারও পাঠিয়েছিলেন।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কথা, নেতাজি ভারত ছাড়ার সিদ্ধান্ত যখন একপ্রকার স্থির করে ফেলেছিলেন ঠিক তখনই ইলা বসুকে পাঠিয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে। উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণা কালীর চরণের ফুল আর চরণামৃত নেওয়া। মাতৃভূমি ত্যাগের পর এই দুটো জিনিসকে সঙ্গে রেখেছিলেন সুভাষচন্দ্র। তবে নেতাজি দেশ ছাড়ার সময় শুধু যে মহম্মদ জিয়াউদ্দিনের ছদ্মবেশ ধরেছিলেন তাই নয়, ইংল্যান্ডে প্রবেশ করার পর এবং জাপানে গিয়েও পাল্টে ফেলেছিলেন নিজের নাম।
তবে এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার, একবার বা দুবার নয়, অবাক লাগলেও এই কথা সত্যি যে নেতাজির মৃত্যুর কথা শোনা গিয়েছিল অন্তত ১৯ বার! নেতাজির গবেষক ডক্টর জয়ন্ত চৌধুরী তার লেখা ‘ক্ষমা করো সুভাষ’ বইয়ে একথা উল্লেখ করেন। লেখক জানান, ১৯৪২ সাল, ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিল মাস, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর এবং ১৯৫৪ সালে ভারত সরকারের শাহনাজ কমিশনের রিপোর্ট, ১৯৫৫ সালে রাশিয়ায়, ১৯৬৮ সালে তার মৃত্যুর কথা শোনা যায়। এরপর আবার, ১৯৭৪ সাল, ১৯৭৭ সাল, ১৯৮৫ সাল, ১৯৯২ সালেও তার মৃত্যু সংক্রান্ত খবর ছড়িয়ে পড়ে। তারপর ২০০১ সালের মে মাস, ২০০৪ সালের নভেম্বর, ২০০৫ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে মুখার্জী কমিশনের রিপোর্ট অনুসারে সব মিলিয়ে বহুবার তার মৃত্যু সম্পর্কিত তথ্য সামনে এসেছে। জেলে বন্দি অবস্থায় মৃত্যু থেকে শুরু করে বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর মত একাধিক কথা প্রকাশ্যে এসেছে।
জীবনের পরতে পরতে তিনি প্রমাণ করেছিলেন, বীরের শুধু জন্ম হয়, বীরত্বের কোনও অন্ত নেই। সেই নেতাজির আজ জন্মদিন। আমাদের তরফ থেকে আজ তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।