বাংলা হান্ট নিউজ ডেস্ক: এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষ কে? গত কয়েকদিন আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে সবচেয়ে উদাসীন মানুষটিও জেনে গিয়েছেন যে সেই নামটা হলো ভ্লাদিমির পুতিন। গত ২০ বছর ধরে রাশিয়ায় ক্ষমতার মসনদে রয়েছেন তিনি। প্রায় ৫০ টি জেট-প্লেন এবং সাত হাজারের বেশি গাড়ির পাশাপাশি বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পারমাণবিক অস্ত্রর মালিকানাও রয়েছে তার কাছে। বর্তমানে ন্যাটো-র সাথে ইউক্রেনের মাখামাখি এবং তারপর রাশিয়া কর্তৃক ইউক্রেনে ভয়াবহ আক্রমণ প্রভৃতি বিষয়ের কারণে পুতিনের নামটি বিশ্বের রাজনীতি সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি অনীহা থাকা মানুষটিও তার নাম শুনে ফেলেছেন। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার শক্তিপ্রয়োগ দেখে পুতিন নামটি নিয়ে রীতিমতো আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু কে এই পুতিন? কিভাবে হয়ে উঠলেন তিনি বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি? এই প্রতিবেদনে সেই বিষয়েই করা হলো আলোকপাত।
পুতিন ১৯৫২ সালে লেনিনগ্রাদে একটি শ্রমজীবী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকে দারিদ্র এবং কমিউনিজম-কে অত্যন্ত কাছ থেকে দেখতে দেখতে বড় হয়েছেন তিনি। তার বাবা সোভিয়েত নেভির একজন সৈনিক এবং মা একজন কারখানার কর্মী ছিলেন। বড় হয়ে ওঠার পথে পুতিন গুপ্তচর সংক্রান্ত উপন্যাস এবং টিভি শো-র প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। তিনি যখন স্কুলে ছিলেন, তখন তিনি সংযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের গোপন গুপ্তচর সংস্থা ‘কেজিবি’-র বিষয়ে শোনেন এবং বড় হয়ে তিনি কীভাবে ‘কেজিবি’-তে যোগ দিতে পারেন সেই বিষয়ে জানতে চান। কেজিবি সদর দফতরের লোকেরা তাকে কঠোর পরিশ্রম করতে এবং আইন নিয়ে সঠিক পড়াশোনা করার পরামর্শ দিয়েছিল। পুতিন ঠিক সেটাই করেছিলেন। লেনিনগ্রাদ স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশুনো সম্পূর্ণ করে তিনি ‘কেজিবি’-তে যোগদান করেছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন তিনি বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন সম্পূর্ণ করে দেশের এক সম্পদে পরিণত হন। ‘কেজিবি’ এজেন্ট হিসাবে ১৭ বছর অতিবাহিত করেছিলেন। ১৯৯১ সাল নাগাদ, পুতিন আনুষ্ঠানিকভাবে কেজিবির সক্রিয় রিজার্ভ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তিনি লেনিনগ্রাদে ফিরে এসেছিলেন, যাকে এখন সেন্ট পিটার্সবার্গ বলা হয় এবং শহরের প্রথম গণতান্ত্রিক মেয়র এবং তার প্রাক্তন আইন অধ্যাপক আনাতোলি সোবচাকের হয়ে কাজ করেন। ওই একই বছরে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। যার ফলে রাশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। ব্যাক্তিগতভাবে পুতিন ওই ঘটনায় ভেঙে পড়েছিলেন।
এরপরের সাত-আট বছর রাশিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল। বরিস ইয়েলৎসিন সেই সময়ের রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ছিলেন, যার কাজ করার ধরণ নিয়ে রাশিয়ার মানুষ একেবারেই সন্তুষ্ট ছিলেন না। রাশিয়ার সামাজিক অবনতিও হতে থাকে সেই সময়। তাকে রাশিয়ার সবচেয়ে খারাপ প্রেসিডেন্ট হিসেবেও আখ্যা দেওয়া হয়। ১৯৯৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখা বরিসকে গোপনে নানানরকম সাহায্য করে প্রেসিডেন্ট পদে বহাল রাখেন। রাশিয়ান জনগন তা একেবারেই মেনে নিতে পারেননি। প্রকাশ্যে লোকে তাকে নিয়ে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। নিজের এই দুর্বল শাসনব্যবস্থার ভিত ঠিক করতে প্রথমে ১৯৯৯ সালে তিনি দেশের ব্যাপারে গোঁড়া ধারণা নিয়ে চলা পুতিন-কে দেশের প্রধানমন্ত্রী পদে আনেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের পরেই সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক মাথা হল প্রধানমন্ত্রী। এরপর বছর শেষ হতে না হতেই ইয়েলৎসিন নিজ দায়িত্ব ছাড়েন এবং পুতিন-কে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের মার্চে একটি নির্বাচন জিতে পুতিন রাশিয়ার স্থায়ী প্রেসিডেন্ট বনে যায়।
এরপর রাশিয়ার বিদ্রোহী গোষ্ঠী “চেসনিয়া”-দের রাশিয়ান নাগরিক হত্যার বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিয়ে পুতিন রাশিয়ান জনগণের নয়নের মণি হয়ে ওঠেন। এরপর টানা ৮ বছর তিনি ক্ষমতায় থাকেন। রাশিয়ায় জিডিপি বিপুল পরিমাণে বেড়ে ওঠে। রাশিয়ার মানুষের আয় ২৫% বৃদ্ধি পায়। অবশ্য এর একটা বড় কারণ হল তেল। তেলের চাহিদা এবং দাম দুইই যত বাড়তে থাকে, রাশিয়ার অবস্থাও তেলের রপ্তানি করে করে ততই উন্নত হতে থাকে। রাশিয়ার পুলিশ এবং মিলিটারির শক্তি বৃদ্ধি পায়।
এরপর পুতিন নিজের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় চালটি চালেন। নিয়ম অনুযায়ী রাশিয়ায় একজন ব্যক্তি ২ দফা মিলিয়ে সর্বোচ্চ টানা ৮ বছর প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন। পুতিন তাই ২০০৮ এ দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদ প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন এবং তার অনুগত দিমিত্রি মেদভেদেব-কে পরবর্তী চার বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট বানিয়ে ফেলেন। স্বাভাবিকভাবেই সমস্ত কার্যকলাপ তখনও চলতো পুতিনের অঙ্গুলি হেলনেই। এরপর ফের ২০১২ সালে পুতিন ফের ক্ষমতায় আসীন। কেউ এখন দেশে তার বিরুদ্ধে কেউ আঙুল তুলতে সাহস করেন না। করলে সেই ব্যক্তি তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলেরই হোন বা কোনও সাংবাদিক, রহস্যজনক ভাবে গায়েব হয়ে যান। কোনও ধনী ব্যবসায়ী বিরুদ্ধ রাজনৈতিক দলকে অর্থসাহায্য করতে গিয়ে গরাদের ওপারে চলে গেছেন এমন উদাহরণও রয়েছে।
পুতিন মনে করেন রাশিয়া যখন সরল এবং দরিদ্র একটি দেশ ছিল, তখন বহির্বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সেই সুযোগে রাশিয়াকে আরও দুর্বল এবং ধ্বংস করার চেষ্টা করেছে, তাই তার কঠোর হওয়াটা প্রয়োজন, কারণ তিনি জানেন দুর্বলদের সাথে কি হয়। সাম্প্রতিক উদাহরণ তো আমাদের চোখের সামনেই রয়েছে, ইউক্রেন। কেমন অদ্ভুত পরিহাস! তাই না?