বাংলা হান্ট ডেস্ক: আমাদের দেশে এমন কিছু রেল স্টেশন (Rail Station) রয়েছে যেগুলির নামের পেছনে লুকিয়ে থাকে বিশেষ কিছু কারণ। যে কারণগুলি অনেকের কাছেই অজানা থাকে। এমতাবস্থায়, আজ আমরা বর্তমান প্রতিবেদনে ইস্ট সেন্ট্রাল রেলের (East Central Railway, ECR) পাটনা-ধানবাদ সেকশনের গোমোহ (Gomoh) রেল স্টেশনের প্রসঙ্গটি উপস্থাপিত করছি। মূলত, ওই রেল স্টেশনের নামকরণ করা হয় নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর (Netaji Subhas Chandra Bose) নামে।
ওই স্টেশনটি নেতাজি এবং ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছে। ঐতিহাসিক নথি থেকে জানা যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে তুলতে এবং স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার জন্য দেশ ছাড়ার আগে নেতাজি ধানবাদের শহর গোমোহতে এক রাত ছিলেন। কংগ্রেসের অহিংস নীতির বিপরীতে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশকে মুক্ত করার পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পরে নেতাজি গোমোহ থেকে কালকা মেইল এক্সপ্রেসে পেশোয়ারের উদ্দেশ্যে রওনা হন।
এমতাবস্থায়, নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর নামে গোমোহ স্টেশনের নামকরণ করে। পাশাপাশি, ২০০৯ সালের ২৩ জানুয়ারি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তৎকালীন রেলমন্ত্রী লালু প্রসাদ গোমোহ স্টেশনটিকে পুনঃসংস্কার করে নতুন নামে উদ্বোধন করেন।
এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে, ১৯৪১ সালের ১৮ জানুয়ারি কলকাতার এলগিন রোডে নিজের বাসভবনে গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় নেতাজি ব্রিটিশ সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে কলকাতা ত্যাগ করেন। ব্রিটিশ সরকারের কঠোর পাহারা সত্বেও কলকাতা থেকে তাঁর প্রস্থানের পরিকল্পনা করেছিলেন বেঙ্গলি ভলান্টিয়ারের সত্য রঞ্জন বক্সী।
কলকাতার বাসভবন থেকে বের হওয়ার পর নেতাজি তাঁর ভাগ্নে শিশির বসুকে নিয়ে রাত ৮ টায় তাঁর “বেবি অস্টিন” গাড়িতে (বিএলএ ৭১৬৯) গোমোহ পৌঁছান এবং ঝাড়খন্ডের লোকো বাজারে বসবাসকারী তাঁর আইনজীবী বন্ধু শেখ মহম্মদ আবদুল্লাহর বাড়িতে যান। এমতাবস্থায়, তিনি শেখ আবদুল্লাহর সাথে পেশোয়ার সফরের পরিকল্পনা ভাগ করে নিয়েছিলেন। পাশাপাশি, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, নেতাজি একজন “পাঠান”-এর বেশি হাওড়া-পেশোয়ার মেইল ৬৩ ট্রেনে উঠবেন।
এদিকে এই পরিকল্পনা অনুযায়ী, শেখ আবদুল্লাহর নির্দেশে গোমোহর আমিন দর্জি তড়িঘড়ি নেতাজির জন্য একটি পোশাক প্রস্তুত করেন। সেই দিনই আমিন নেতাজিকে রাত ১ টায় স্টেশনে নিয়ে যান এবং তিনি তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ট্রেনে ওঠেন। পরবর্তীতে এই ট্রেনটি কালকা এক্সপ্রেস নামে পরিচিতি লাভ করে। ২০২১ সালে ভারতীয় রেল এই ট্রেনের নাম পরিবর্তন করে নেতাজি এক্সপ্রেস করে। সুভাষচন্দ্র বসুর দেশ ত্যাগের এই ঘটনা ইতিহাসের পাতায় “দ্য গ্রেট এস্কেপ” (The Great Escape) হিসেবে বিবেচিত হয়।
এমতাবস্থায়, “দ্য গ্রেট এস্কেপ”-এর স্মৃতি রক্ষার্থে ঝাড়খণ্ডের গোমহ অর্থাৎ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জংশনের ১-২ নম্বর প্ল্যাটফর্মের মধ্যে নেতাজির একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি স্থাপন করা হয়েছে। পাশাপাশি, ওই পুরো ঘটনাটিও সংক্ষিপ্তভাবে সেখানে থাকা একটি ফলকে লেখা রয়েছে। এই বীরত্বপূর্ণ কাহিনির পেছনে থাকা ঘটনাটি হল, ১৯৪০ সালের ২ জুলাই হলওয়েল আন্দোলনের কারণে ভারতীয় প্রতিরক্ষা আইনের ১২৯ ধারায় নেতাজিকে গ্রেফতার করা হয়। তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার জন ব্রিন নেতাজিকে গ্রেফতার করে প্রেসিডেন্সি জেলে পাঠান।
এদিকে জেলে যাওয়ার পর নেতাজি আমরণ অনশন পালন করেন। যার ফলে তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটে। পরবর্তীতে ১৯৪০ সালের ৫ ডিসেম্বর ব্রিটিশ সরকার তাঁকে এই শর্তে মুক্তি দেয় যে, তিনি সুস্থ হয়ে উঠলে তাঁকে ফের গ্রেফতার করা হবে। এমতাবস্থায়, নেতাজি মুক্তি পেয়ে কলকাতার এলগিন রোডে তাঁর বাসভবনে আসেন। ১৯৪১ সালের ২৭ জানুয়ারি নেতাজির সঙ্গে জড়িত মামলার শুনানি হওয়ার কথা ছিল। তবে, ২৬ জানুয়ারি ব্রিটিশ সরকার জানতে পারে যে নেতাজি কলকাতাতেই নেই! নেতাজি আট দিন আগেই ১৯৪১ সালের ১৬-১৭ জানুয়ারি রাত ১ টা নাগাদ চেহারা পরিবর্তন করে গোমোহর উদ্দেশ্যে রওনা হন।
কথিত আছে যে, শিশির বসুর সাথে গোমোহ পৌঁছনোর পরে তিনি গোমোহ হাতিয়াতাদের জঙ্গলে লুকিয়ে ছিলেন। ওই জঙ্গলেই স্বাধীনতা সংগ্রামী আলিজান ও অ্যাডভোকেট চিরঞ্জীব বাবুর সঙ্গে তাঁর গোপন বৈঠক হয়। পরে সন্ধ্যায় নেতাজি গোমোহর লোকো মার্কেটে শেখ আবদুল্লাহর সঙ্গে দেখা করতে যান। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি যে, এরপর ব্রিটিশরা তাঁকে আর কখনও গ্রেফতার করতে পারেনি।