পৃথ্বীশ দাশগুপ্ত : 500বছর ধরে চলে আসা একটা মন্দির প্রতিষ্ঠার লড়াই আজ শেষ হলো ।জয় হলো হিন্দু ধর্মীয় ভাবাবেগের। কিন্তু আশ্চর্যভাবে আজও আমরা দেখলাম সারা বাংলার সাধারন মানুষের এই মন্দির প্রতিষ্ঠা কে কেন্দ্র করে যে স্বতঃস্ফূর্ত আনন্দের বহিঃপ্রকাশ সেটাকে জোর করে হত্যা করার প্রয়াস চালাল বেশকিছু মানুষ ।কখনো উর্দির আড়ালে, কখনো লকডাউন এর আইনি প্রতিবন্ধকতা জারি করে কখনো বা আগ্নেয়াস্ত্রের লাল চোখ দেখিয়ে তারা বন্ধ করে দিতে চাইল বলা ভালো গলা টিপে হত্যা করতে চাইল আপামর বাঙালি ধর্মীয় ভাবাবেগকে ।
এখন প্রশ্ন আসে কে এই রাম? বাংলার ইতিহাসে রামের প্রাসঙ্গিকতা কোথায় ?এবং কবে থেকে বাঙালি অস্তিত্ব রাম নামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে?
ইতিহাস বলে শ্রী রামচন্দ্র হলেন ভগবান নারায়নের অবতার।সাম্প্রতিককালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির উত্থানের সাথে সাথে সর্বোচ্চ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে রাম মন্দির নির্মাণকে কেন্দ্র করে বাংলার রাজনীতিতে তৃণমূল সুপ্রিমো থেকে অতি বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা প্রকাশ্যে সমালোচনা করে বলছেন বঙ্গ সমাজ জীবনে ভগবান রামের কোন প্রভাব কখনোই ছিল না। সোজা বাংলায় রাম বাঙালির আরাধ্য দেবতা নয়। এটা মূলত হিন্দি বলয় থেকে রাজনৈতিক কারণে বাংলায় রাম কে ব্যবহার করছে বিজেপি।অথচ বাংলার ইতিহাস বলছেবাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব হলো শারদোৎসব যা ছিলো রামচন্দ্রের শরৎকালে করা অকালবোধন।
আনুমানিক চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার অন্তর্গত ফুলিয়া গ্রামের কৃত্তিবাস মুখোপাধ্যায় (ওঝা) ছিলেন মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একজন প্রধান কবি।
আনুমানিক ১৪০৩ খ্রিষ্টাব্দে বাল্মীকি রচিত সংস্কৃত রামায়ণের সহজবোধ্য বাংলা পদ্যানুবাদ করেছিলেন তিনি। বাঙালির আবেগ, অনুভূতি ও রুচির দিক লক্ষ্য রেখে সর্বজনবোধ্য পদ্যে মূল সংস্কৃত রামায়ণের ভাবানুবাদ করায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ ব্যাপক জনপ্রিয়তা বেড়েছিল বাংলায়, যা আজও অক্ষুন্ন।বাংলার সামাজিক রীতিনীতি ও লৌকিক জীবনের নানা অনুষঙ্গের প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি সংস্কৃত রামায়ণ উপাখ্যানের বঙ্গীকরণ করেন। কৃত্তিবাস অনূদিত রামায়ণ কৃত্তিবাসী রামায়ণ নামে পরিচিতি।
আবার পঞ্চদশ শতাব্দীর বাঙালি ধর্ম ও সমাজ সংস্কারক চৈতন্য মহাপ্রভু ছিলেন ভাগবত পুরাণ ও ভগবদ্গীতা-য় উল্লিখিত দর্শনের ভিত্তিতে সৃষ্ট বৈষ্ণব ভক্তিযোগ মতবাদের প্রবক্তা। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তাঁকে শ্রীকৃষ্ণের পূর্ণাবতার মনে করেন।
তার সময় কালে ভগবান রামচন্দ্রের পূজোর নজির পাওয়া যায় তৎকালীন বাংলায়, কালনার গৌরী দাস পন্ডিতের শ্রীপাটে, শান্তিপুরের বড় গোস্বামী ও মধ্যম গোস্বামীর সুত্রাগড় অঞ্চলের বাড়িতে, হাওড়া রামরাজাতলায়, পাঁশকুড়ার রাজবাড়িতে ও শ্রীরামপুরে। মহাপ্রভু নিজেরও রাম ভক্তি পরায়ন থাকার প্রমাণ পাওয়া যায় তার সমস্ত লীলাকাল জুড়ে। যেমন দক্ষিণা পথে চলার সময় মহাপ্রভু দ্বারা যে সংকীর্তন শোনা গেছিল তাহল কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব কৃষ্ণ কেশব পাহি মাম্ – রাম রাঘব রাম রাঘব রাম রাঘব রক্ষ মাম্।
বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ভগবান রামের পূজা অনেক আগে থেকে হয়ে এসেছে।পশ্চিমবঙ্গের কাটোয়া মহকুমায় প্রায় কুড়িটির মত রামের মূর্তি আছে।এছাড়া বাঁকুড়া জেলাতেও রাম মন্দির পাওয়া যায়। বাংলায় রঘুনাথশিলা রূপে পূজো করা হত শ্রীরামচন্দ্রের। রাঢ়বাংলায় রামকে নিয়ে অনেক মুদ্রা পাওয়া গেছে। কাজী নজরুল ইসলাম তাকে নিয়ে অনেক গান লিখেছেন। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, রাণী রাসমণি, মুরারি গুপ্ত, চৈতন্য জীবনী লেখক দয়ানন্দ, সহ অনেকেই রামের পূজা করতেন বাংলায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণবমত জনপ্রিয় হওয়ার আগে অনেকেই রাম মন্ত্রে দীক্ষা নিতেন, রাণী রাসমণি রঘুবীরের রথযাত্রা করতেন।
এছাড়াও বাংলার প্রতি জনপদে প্রতিটি অঞ্চলে রাম ও লক্ষণ নামের ভাতৃদ্বয় আজও বিদ্যমান। আজও বাঙালির ভ্রম সংশোধনের ক্ষেত্রে ‘এ-রাম’ শব্দটি সর্বজনবিদিত। বাংলার সাধারণ মানুষ আজও প্রতিপক্ষের দিকে মোক্ষম চাল দেওয়াকে ‘রাম-বান’ বলেই অভিহিত করেন। আপামর বাঙালির অন্ধকারাচ্ছন্ন ভয়ার্ত মূহুর্তে ‘রাম’ নামেই আস্থা আজও।
এছাড়াও বাংলার শহর থেকে গ্রামে বহু অঞ্চলের নামের সাথে জড়িয়ে আছে রাম, যেমন রামরাজাতলা, রামপুর, রাম বাগান, শ্রীরামপুর আরো অনেক।আর ধর্মপ্রাণ বাঙালির নিত্য উপাষোনা হরি নাম সংকির্তনে ‘হরে কৃষ্ণ হরে রাম’ এর মাধ্যমে বঙ্গ সমাজ জীবনের অঙ্গে অঙ্গে পুরোষোত্তম শ্রীরাম দেবতা রূপে প্রতিষ্ঠিত।