বাংলা হান্ট ডেস্ক: ইউক্রেনে হামলার জন্য জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে (UNSC) রাশিয়ার বিরুদ্ধে আনা নিন্দা প্রস্তাবে ভোট দেওয়া থেকে বিরত থাকল ভারত। এদিকে, এই প্রসঙ্গে কোনো কোনো মহলে এর তীব্র সমালোচনাও হলেও, অতীতের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে, ভারতের এই পদক্ষেপ অত্যন্ত চিন্তাশীল ও প্রশংসনীয়। সর্বোপরি, প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন (USSR) এবং বর্তমান রাশিয়া সর্বদা UNSC-তে ভারতীয় স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রয়োজনের সময়ে ভেটো ব্যবহার করতে কখনই পিছপা হয়নি।
ভারতের সাথে রাশিয়া কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ১৯৫৭ সাল থেকে চলছে। তারপর থেকে, একটি বা দু’টি নয়, মোট ছয়টি এমন ঘটনা ঘটেছে, যখন রাশিয়া তার ভেটো ক্ষমতা দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবগুলিকে আটকে দিয়েছে। আসুন, রাশিয়া কিভাবে ভারতের পক্ষ নিয়ে সুবিধাপ্রদান করেছে সেই ঘটনাগুলি জেনে নেওয়া যাক।
২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৭ – কাশ্মীর প্রতিরক্ষা:
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে কাশ্মীর, ভারত ও পাকিস্তান থেকে স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এদিকে, কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তান কাশ্মীরে আক্রমণ করলে কাশ্মীরি নেতারা ভারতের কাছে সাহায্য চান। ভারত অধিগ্রহণ নথিতে স্বাক্ষর করার শর্তে কাশ্মীরকে সাহায্য করেছিল কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু বিষয়টি জাতিসঙ্ঘে নিয়ে যান। নেহরুর এই ভুলের শাস্তি ভারতকে ভোগ করতে হয়েছে।
১৯৫৭ সালে এই ধরনের একটি সুযোগ এসেছিল যখন ১০ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়া, কিউবা, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি প্রস্তাব নিয়ে আসে যাতে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টকে ভারত ও পাকিস্তানের সাথে কথা বলার জন্য অনুরোধ করা হয়। এজন্য বিতর্কিত এলাকাগুলি থেকে নিজ নিজ সেনা প্রত্যাহারের জন্য উভয় দেশকেই রাজি করানোর পরামর্শও দেওয়া হয়।
সেখানে একটি প্রস্তাবও ছিল যে, জাতিসঙ্ঘকে সাময়িকভাবে কাশ্মীরে তাদের বাহিনী মোতায়েন করা উচিত। এদিকে, এই প্রস্তাবে সুইডেন ভোটদানে বিরত থাকলে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে তার ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে। তখন UNSC-র প্রেসিডেন্টও ছিলেন সুইডেন থেকে। যদিও, অস্ট্রেলিয়া, চিন, কলম্বিয়া, কিউবা, ফ্রান্স, ইরাক, ফিলিপাইন ও আমেরিকা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।
১৮ ডিসেম্বর, ১৯৬১ – গোয়া, দমন এবং দিউকে বিদায়
গোয়া-দমন ও দিউতে ভারতের সামরিক বাহিনী ব্যবহারে আপত্তি জানিয়ে নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের বিরুদ্ধে একটি যৌথ প্রস্তাব নিয়ে আসে ফ্রান্স, তুরস্ক ও আমেরিকা। ওই প্রস্তাবে ভারত সরকারের কাছে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার এবং ১৯৬১ সালের ১৭ ডিসেম্বরের আগের পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের দাবি ছিল।
ওই প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন, সিলন (তৎকালীন শ্রীলঙ্কা), লাইবেরিয়া এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী প্রস্তাবের বিরোধিতা করে ভারতকে সমর্থন করেছিল। অপরদিকে, চিলি, চিন, ইকুয়েডর, ফ্রান্স, তুরস্ক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের বিরোধিতা করে প্রস্তাবটিকে সমর্থন করে। বিতর্কের আলোচনার সময়, জাতিসঙ্ঘে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত ভ্যালেরিয়ান জোরিন বলেন, “পর্তুগালের রক্ষকরা জাতিসঙ্ঘের স্বার্থের পক্ষে নয় বরং উপনিবেশবাদের পক্ষে, যা বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে লজ্জাজনক দর্শন।”
২২ জুন, ১৯৬২ – কাশ্মীর সমস্যা আবার দেখা দেয়
আমেরিকার সমর্থনে, আয়ারল্যান্ড নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব এনেছিল, যেখানে ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে কাশ্মীর বিরোধ সমাধানের দাবি জানানো হয়। এতে বলা হয় যে, উভয় সরকারের উচিত এমন পরিবেশ তৈরি করা যাতে আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো যায়। USSR আবারও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো ক্ষমতা আরোপ করে। রোমানিয়াও প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে ভারতকে সমর্থন করেছিল। যদিও, ঘানা এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী ভোটদান থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখে। অপরদিকে, চিলি, চিন, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, ভেনিজুয়েলা এবং আমেরিকা প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১- পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতির আহ্বান
আমেরিকার নেতৃত্বে একটি প্রস্তাবে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করার দাবি করা হয়েছিল, যার বিরুদ্ধে রাশিয়া ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে। আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, চিন, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিওন, সোমালিয়া, সিরিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবের সমর্থনে ভোট দেয়। তৎকালীন জনসঙ্ঘ (পরবর্তীতে বিজেপি) সভাপতি অটল বিহারী বাজপেয়ী রাশিয়ার ভেটোকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
এই প্রসঙ্গে দিল্লির রামলীলা ময়দানে আয়োজিত এক সমাবেশে বাজপেয়ী বলেছিলেন, “বর্তমান সঙ্কটে যে আমাদের সমর্থন করবে সেই আমাদের বন্ধু। মতাদর্শের লড়াই পরে হবে।” উল্লেখ্য যে, জনসঙ্ঘ বামপন্থীদের বিরোধী ছিল, যার নেতৃত্বে রয়েছে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বর্তমনে রাশিয়া।
৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ – শরণার্থী ইস্যু:
আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিয়েরা লিওন এবং সোমালিয়া উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তনের সুবিধার্থে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে আসে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে পঞ্চমবারের মতো ভারতকে সমর্থন করেছিল। একই সময়ে, আমেরিকা আবার ভারতের বিরোধিতা করে প্রস্তাবকারী দেশগুলোকে সমর্থন করে। পাশাপাশি, পোল্যান্ড প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। তবে, সেবার ভোট থেকে দূরে থাকে ইউকে এবং ফ্রান্স।
১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ – সেনা প্রত্যাহারের দাবি:
আমেরিকার প্রদত্ত প্রস্তাবে ভারত ও পাকিস্তান সরকারকে তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ডে যুদ্ধবিরতি এবং বাহিনী প্রত্যাহারের জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। USSR তখন আবার প্রস্তাবে ভেটো দেয়। পোল্যান্ডও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। যদিও ফ্রান্স এবং ইউকে আবার ভোটে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। অপরদিকে, আর্জেন্টিনা, বেলজিয়াম, বুরুন্ডি, চিন, ইতালি, জাপান, নিকারাগুয়া, সিরিয়া লিওন, সোমালিয়া, সিরিয়া এবং আমেরিকা এই প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়।
এইভাবে, নিরাপত্তা পরিষদে ভারতের বিরুদ্ধে আনা ছয়টি প্রস্তাবে রাশিয়া ভেটো ক্ষমতা ব্যবহার করে ভারতের পাশে থাকে। অপরদিকে, আমেরিকা সেগুলিকে সমর্থন করে। এই সময়ে কিছু শক্তিশালী দেশ নিরপেক্ষতা প্রয়োগ করলেও আমেরিকা প্রতিটি সুযোগে ভারতের বিরোধিতা করে চলে। ১৯৭১ সালে, ভারতের বিরুদ্ধে দু’টি প্রস্তাব আনা হয়েছিল, যখন ফ্রান্স এবং ইউকে ভোটে অংশ না নিয়ে নিরপেক্ষতার অবস্থান গ্রহণ করলেও আমেরিকা তখনও ভারতের বিরোধিতা করেছিল।