বাংলা হান্ট নিউজ ডেস্ক: আমরা সবাই জানি যে জীবন একটা সময় আমাদের সকলেরই পরীক্ষা নেয়, কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে এটি জীবনকে এমন করে তোলে যে তাদের এই পরীক্ষায় বসারও ক্ষমতা থাকে না। আমাদের আজকের প্রতিবেদনটি এমনই একজন বাস্তব জীবনের নায়কের, যিনি তার আবেগ দিয়ে প্রমাণ করেছিলেন ইচ্ছাশক্তি থাকলে কোনও কিছুই অসম্ভব নয়। আমাদের আজকের আলোচ্য ব্যক্তি হলেন রমেশ ঘোলপ। যার শৈশব কেটেছে মজুরের কাজ করে কেটেছে। জন্মের পরেই পোলিও তার একটি পা গ্রাস করেছিল। তা সত্ত্বেও তিনি আজ একজন আইএএস অফিসার।
মহারাষ্ট্রের সোলাপুর জেলার ওয়ারসি তহসিলের মহাগাঁওতে জন্মগ্রহণকারী রমেশ ঘোলপ জ্ঞান হওয়ার পর থেকে তার পরিবারকে দু’বেলা রুটির জন্য জীবন সংগ্রাম করতে দেখেন। রমেশের বাবা সাইকেল মেরামতের দোকান চালাতেন। তাতে সংসার চলতো কোনওরকমে। গোঁদের ওপর বিষফোঁড়া ছিল তার বাবার নেশা এবং তা ছিল এতটাই ভয়ংকর যে সে তার স্ত্রী ও ছোট ছেলেমেয়েদের ক্ষুধাও চোখে পড়তো না তার এবং সমস্ত টাকার বেশিরভাগ অংশ মদের পেছনে উড়িয়ে দিতেন। ঘরের অবনতির পাশাপাশি আরেকটা বড় দুঃখ সামনে আসে যখন দেড় বছরের রমেশের বাম পা পোলিওতে আক্রান্ত হয়। বাড়ির খারাপ অবস্থা দেখে রমেশের মা বুঝতে পেরেছিলেন যে তার স্বামী বাড়ি চালাতে পারবেন না।তারপর গ্রামে গ্রামে গিয়ে চুড়ি বিক্রি করতে লাগলেন রমেশের মা। রমেশ এবং তার ভাইবোনরাও এই কাজে তাদের মায়ের পাশে দাঁড়াতেন
এতকিছুর মধ্যেও ছোটবেলা থেকেই কিভাবে যেন রমেশের মনে ঢুকে যায় পড়ালেখা করার আগ্রহ। রমেশ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যান। পরবর্তীতে লেখাপড়ার জন্য তাকে তার মামার গ্রাম বারসিতে যেতে হয়। তার শিক্ষকরা রমেশের পড়াশোনার আগ্রহ দেখে খুব খুশি ছিলেন। তিনি আশা করেছিলেন যে রমেশ আরও ভাল করবে, কিন্তু তার জীবনের পরীক্ষাগুলি রমেশের স্কুলের পরীক্ষার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। তারমধ্যেও প্রবল প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে ২০০৫ সালে, রমেশ দ্বাদশ শ্রেণীতে পড়ার সময় নিজের বাবাকে হারান।
বাবার শেষকৃত্যে সামিল হতে বাড়ি ফেরার মতো টাকাও ছিল না রমেশের। এক্ষেত্রে প্রতিবেশীরা সাহায্য করেছিল। বাবার মৃত্যুতে রমেশ গভীরভাবে শোকাহত হন। তখন দ্বাদশ শ্রেণির মডেল পরীক্ষা শুরু হতে আর মাত্র চার দিন বাকি। তিনি যেতে চাননি, কিন্তু তার মায়ের অনুপ্রেরণায়, তিনি ফিরে এসে রসায়ন পরীক্ষা দেন। কিন্তু তিনি অন্য মডেল পরীক্ষা দেননি বা তার প্রোজেক্টগুলিও জমা করেননি। মূল পরীক্ষার আর মাত্র এক মাস বাকি ছিল কিন্তু রমেশ মানসিক দিক দিয়ে ভেঙে পড়েছিলের। এর মধ্যে তিনি তার শিক্ষকের কাছ থেকে একটি চিঠি পান যাতে লেখা ছিল যে তিনি যে পরীক্ষা দিয়েছেন তাতে ৪০ নম্বরের মধ্যে ৩৫ নম্বর পেয়েছেন। এর সাথে সাথে শিক্ষক রমেশকে ডেকে তার সাথে দেখা করার জন্য, তার সাথে দেখা করার পর তার শিক্ষক তাকে উৎসাহিত করে, রমেশও প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। তার কঠোর পরিশ্রমের ফলস্বরূপ দ্বাদশ পরীক্ষায় তিনি ৮৮.৫ শতাংশ নম্বর পেয়েছে।
এর পরে তিনি ডিএড করেন কারণ এটিই একমাত্র কোর্স যেটিতে কম টাকা খরচ হয় এবং এটি করার পরে তিনি চাকরি পেতে পারতেন। রমেশ ডিএড করেছিলেন এর সাথে, তিনি ডিস্টেন্স থেকে স্নাতকও সম্পূর্ণ করেছিলেন। ২০০৯ সালে, রমেশ শিক্ষক হয়েছিলেন। মজুরের কাছ করে পেট চালানো এই পরিবারটির মনে হয়েছিল তাদের বড় স্বপ্ন পূরণ হয়েছে যখন তাদের ছেলে শিক্ষক হয়েছে। কিন্তু, কে জানত রমেশের এখনও অনেক পথ যেতে হবে। রমেশের পুরো পরিবার একটি ছোট ঘরে থাকত। রমেশের মা যখন রেশন নিতে সরকারি রেশনের দোকানে যেতেন, রমেশ দেখতেন দোকানদার কীভাবে গরিবদের রেশন দিতে অস্বীকার করছে। একইভাবে মায়ের বিধবা ভাতা পেতেও অনেক সমস্যা হতো।কলেজে পড়ার সময়, রমেশ যখন ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন, তখন ছাত্ররা তাদের সমস্যা নিয়ে তহসিলদারের কাছে যেতেন। এটা দেখে রমেশের মনে হল, তহসিলদারের অনেক ক্ষমতা আছে। তিনি যদি তহসিলদার হতে পারেন, তাহলে সে তার মায়ের মতো অন্য মহিলাদের জন্য ভালো কিছু করতে পারবে। এসব ভেবে রমেশ সিদ্ধান্ত নিল তিনি বড় অফিসার হওয়ার চেষ্টা করবেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে অধিকারের জন্য আওয়াজ তোলার চেয়ে যে ব্যবস্থা থেকে গরীবদের তাদের প্রাপ্য দেওয়া যায় তার অংশ হওয়া অনেক বেশি কার্যকরী। এরপর রমেশ তার মায়ের নেওয়া ঋণ থেকে টাকা নিয়ে ইউপিএসসির প্রস্তুতি নিতে পুনে যান।
আজ শুনলেও আশ্চর্য লাগবে যে রমেশ যে লক্ষ্যে যাত্রা করেছিলেন, সেখানে পৌঁছানোর পথও তিনি জানতেন না। এমনকি রমেশ তিনি ইউপিএসসি এবং এমপিএসসি-এর অর্থও জানতেন না, কোনও ভালো কোচিংয়ে নাম লেখানোর মতো টাকাও তাঁর কাছে ছিল না। তারপর তিনি কোচিংয়ে পড়ান এমন শিক্ষকদের সঙ্গে দেখা শুরু করেন, যাতে তিনি বিষয়টি জানতে পারেন, এই শিক্ষকদের মধ্যে একজন ছিলেন অতুল লান্ডে। রমেশ অতুলকে কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে অনুরোধ করে, যেমন ইউপিএসসি কী? যদি সে ইংরেজি না জানে, তাহলে সে কি মারাঠিতে এই পরীক্ষা দিতে পারবে? তারা কি এই পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্য? এমন প্রশ্নগুলির উত্তরে অতুল বলেছিলেন যে এমন কিছু নেই যা আপনাকে ইউপিএসসি পরীক্ষায় বসতে বাধা দিতে পারে। রমেশের মতে, অতুলের এই একটি উত্তরের কারণে, সে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং তার লক্ষ্য অর্জন করেছে।
রমেশ ২০১০ সালে প্রথম ইউপিএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন, কিন্তু সফল হননি। এর পর তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি রাজনীতির সাহায্যে অভাবীকে সাহায্য করবেন। এই চিন্তা করে তিনি কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে স্থানীয় একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। পঞ্চায়েত নির্বাচনে নিজের মাকে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। কঠোর পরিশ্রম ও ভালো চিন্তার পরও রমেশের মা কয়েক ভোটে হেরে যান নির্বাচনে। এই পরাজয়ে রমেশের দুঃখ হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু তা হয়নি। উল্টো তার উৎসাহ আরো বেড়ে গেল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তারা লড়াই করবে এবং নতুন কিছু করবে। একদিন তিনি গ্রামের লোকদের একত্র করে তাদের সামনে প্রতিজ্ঞা করলেন যে, তিনি উচ্চপদস্থ অফিসার না হওয়া পর্যন্ত গ্রামে পা রাখবেন না।
এর পরে রমেশকে এগিয়ে যেতে বাধা দিতে পারে এমন কিছু ছিল না। যে চাকরিটিকে রমেশের পরিবার স্বপ্ন হিসেবে ভাবছিল, রমেশের সেটি ছেড়ে যেতে বেশি সময় লাগেনি। অজানা লক্ষ্যে রমেশের চাকরি ছেড়ে দেওয়া তার মতো দরিদ্র পরিবারের জন্য জুয়া খেলার চেয়ে কোনও অংশে কম ছিল না। রমেশ স্টেট ইনস্টিটিউট অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যারিয়ারস (SIAC) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এটি তাকে একটি হোস্টেল এবং ইউপিএসসি-এর প্রস্তুতির জন্য একটি বৃত্তি জোগাড় করে দেয়। নিজের অন্যান্য খরচ মেটাতে রমেশ পোস্টার আঁকতেন। ২০১১ সালে রমেশ ফের এই পরীক্ষায় বসেন ইউপিএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন সর্বভারতীয় স্তরে ২৮৭ নম্বরে থেকে। ২০১২ সালে চুড়ি ব্রিকেতার ছেলে রমেশ গোরখ ঘোলপ ইউপিএসসি পাশ করে গ্রামে ফিরে আসেন এবং তার পাশাপাশি তিনি একটি বড় কৃতিত্বও অর্জন করেছিলেন। ইউপিএসসির পাশাপাশি রমেশও এমপিএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। যখন ফলাফল এল, রমেশ লিখলেন নতুন ইতিহাস। তিনি ১৮০০ এর মধ্যে ১২৪৪ নম্বর পেয়ে শীর্ষে ছিলেন। এটি ছিল এই পরীক্ষায় প্রাপ্ত এখন পর্যন্ত কোনো প্রার্থীর প্রাপ্ত সর্বোচ্চ নম্বর।
রমেশ পলপ ঝাড়খণ্ড ক্যাডারে জায়গা পেয়েছিলেন। ৩০শে জুন ২০১৯ সালে তিনি ঝাড়খণ্ডের কোডারমার ২২ তম ডিসি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। এর আগে তিনি ঝাড়খণ্ডের সেরাকেলার ডিসি ছিলেন। এছাড়াও তিনি আরও অনেক জেলায় ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। রমেশের মতে, সে আইএএস হওয়ার পর, তার মা তাকে অনেকবার বলেছেন যে “রমেশ, আমরা আগে যেমন ছিলাম, আজ অনেকেরই একই অবস্থা। প্রথমত, এই ধরনের লোকদের সমস্যার কথা শুনে, তাদের জন্য কাজ করতে হবে।” আর রমেশ ঠিক তাই করেছিল। রমেশ এ পর্যন্ত ৪০০ টিরও বেশি এই ধরনের উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন একাধিক শিশুকে। এ ছাড়া রমেশ সরাসরি গণআদালত করে জনসাধারণের সঙ্গে তাদের সমস্যা সমাধান করেন। তিনি যখন শিশুদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বই বিতরণ করেন, তখন তার মনে পড়ে কিভাবে তিনি শৈশবে এই জিনিসগুলির জন্য আকুল আকাঙ্ক্ষা করতেন কিন্তু পেতেন না। রমেশ খুন্তি ও বোকারো জেলার ডিসি থাকাকালে দুর্নীতিবাজ এবং যারা গরীবদের উপর অত্যাচার এমন বেশকিছু কালোবাজারি ও অনিয়মের অপরাধে যুক্ত রেশন দোকানদার ও রকেলের হকারদের জেলে পাঠিয়েছিলেন। আজ রমেশ সাধারণ মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণা ও উদাহরণ।