বাংলা হান্ট ডেস্ক: এই প্রতিবেদনটির শুরুতেই চিকিৎসক কে এম চেরিয়ানের আত্মজীবনীতে থাকা একটি অংশের প্রসঙ্গ উপস্থাপিত করতেই হয়। মূলত, “হ্যান্ড অফ গড” নামের ওই অংশে লেখা ছিল যে, ২০০১ সালে এপিজে আবদুল কালাম তখনও ভারতের রাষ্ট্রপতি হননি। সেই সময়ে চেরিয়ান এবং ড: কালাম একটি অনুষ্ঠানে দেখা করেছিলেন। যেখানে কালাম তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, হিন্দু আর মুসলমানের রক্তের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কিনা? যার উত্তরে চেরিয়ান জানান, উভয়ের রক্তের রঙই একই। যা শুনে আব্দুল কালাম তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেন। এমতাবস্থায়, প্রশ্ন উঠতে পারে যে আমরা হঠাৎ কেন এই প্রসঙ্গটির উপস্থাপন করলাম? এটির উত্তর প্রতিবেদনটি পড়লেই ভালোভাবে বোঝা যাবে।
মূলত, কোনো ব্যক্তির হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেলেই তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। এমতাবস্থায়, কোনো ব্যক্তির যদি মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয় সেক্ষেত্রে কি তিনি জীবিত বলে গণ্য হবেন? এই প্রশ্নই বছরের পর বছর ধরে মানুষের মনে দাগ কেটে যাচ্ছিল। যদিও, আধুনিক বিজ্ঞান এর নাম দিয়েছে ব্রেন ডেথ। এমতাবস্থায়, ব্রেন ডেথ হলেও শরীরের অঙ্গগুলি দান করা সম্ভব।
বিশ্বের প্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি:
বিজ্ঞানের উন্নতির সাথে সাথে, ডাক্তাররা বুঝতে পেরেছিলেন যে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে অন্য কোনো রোগীর জীবন বাঁচানো সম্ভব। যেমন কারোর ক্ষেত্রে দু’টি কিডনি কাজ করা বন্ধ করে দিলে একটি কিডনি প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে কাজ চালানো সম্ভব। এছাড়াও, মৃত্যুর পরে চক্ষুদানের ঘটনাও ঘটে। তবে, জেনে অবাক হবেন যে, হৃৎপিন্ডও প্রতিস্থাপন করা সম্ভব।
অর্থাৎ, মৃত রোগীর থেকে হৃৎপিণ্ড স্থানান্তরের জন্য মাত্র কয়েক মিনিট সময় পাওয়া যায়। এমতাবস্থায়, ১৯৬৭ সালে, চিকিৎসকেরা প্রথমবারের মতো হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে সফল হন। এই অপারেশনটি করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। যেখানে ২৪ বছর বয়সী ডেনিস ডারভালের হৃৎপিণ্ড অন্য একজন রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়।
১৯৬৮ সালে ভারতে প্রথম প্রচেষ্টা করা হয়:
বিশ্বের প্রথম হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট অপারেশনের পরের বছরই, ভারতেও একটি প্রচেষ্টা করা হয়েছিল। আর এই কাজ করেছিলেন ডক্টর প্রফুল্ল কুমার সেন। মূলত, তিনি ১৯৬৪ সাল থেকে কুকুরের হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মানুষের উপর এই প্রক্রিয়াটি চেষ্টা করার ক্ষেত্রে একটি বাধা ছিল। তবে, ১৯৬৮ সালে, ডাঃ সেন হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করতে সফল হন, কিন্তু তারপরও এই অপারেশন ব্যর্থ হয়। কারণ যাঁর শরীরে হৃৎপিন্ড প্রতিস্থাপিত হয়েছিল তিনি অল্প সময়ের মধ্যেই মারা যান।
২৬ বছর পর মেলে সাফল্য:
AIIMS-এর কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান ডাঃ পি ভেনুগোপাল, ১৯৯৪ সালের ৩ আগস্ট তিনি তাঁর দলের সাথে ভারতের প্রথম সফল হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট করেন। যেখানে “ব্রেন ডেথ” হওয়া একজন মহিলার হৃৎপিন্ড ৪৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির শরীরে প্রতিস্থাপন করা হয়েছিল। এমতাবস্থায়, এই অপারেশনের পরে তিনি আরও ১৭ বছর বেঁচেছিলেন। ওই সময়ে দক্ষিণ ভারতে আরও একজন সার্জন ছিলেন, যিনি হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের চেষ্টায় নিযুক্ত ছিলেন। তাঁর নামই ছিল ডাঃ কে এম চেরিয়ান। আর তিনিই ঘটিয়েছিলেন এক অনন্য ঘটনা।
মুসলমানের শরীরে ব্রাহ্মণের হৃদয়:
জানা গিয়েছে, ৩৩ বছর বয়সী হেমলতা সুন্দররাজন পল্লভরামের কাছে একটি রাস্তা পার হতে গিয়ে একটি দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। পাশাপাশি, হেমলতাকে হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসকরা তাঁর “ব্রেন ডেথ”-এর ঘোষণা করেন। হেমলতার স্বামী রেলে চাকরি করতেন। এমতাবস্থায়, তাঁরা হেমলতার হৃৎপিন্ডটি অন্য রোগীর শরীরে প্রতিস্থাপনের কথা ভাবেন। সেই সময়ে ৩৮ বছর বয়সী মামুন বিবির দ্রুত হার্ট ট্রান্সপ্লান্টের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু অর্থনৈতিক ভাবে দুর্বল থাকায় তিনি তা পারছিলেন না। এমতাবস্থায়, ডাক্তার চেরিয়ান তাঁর অপারেশনের সমস্ত দায়িত্ব নিজের উপর নিয়েছিলেন। রাত ৯ টা নাগাদ চেরিয়ান অপারেশন শুরু করেন এবং রাত ২ টোয় সফলভাবে অপারেশন সম্পন্ন হয়।
আর এভাবেই ভারতে প্রথমবারের মতো একটি বেসরকারি হাসপাতালে হার্ট ট্রান্সপ্লান্ট সার্জারি করা হয়েছিল। পাশাপাশি, এই ঘটনা ছিল ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণও। একজন ব্রাহ্মণ মহিলার হৃৎপিণ্ড একজন মুসলিম মহিলার শরীরে প্রবেশ করানো হয়েছিল, আর যিনি এই কাজ করেছিলেন তিনি ছিলেন একজন খ্রিস্টান ডাক্তার। এমতাবস্থায়, যতদিন মামুন বিবি বেঁচে ছিলেন, হেমলতার সন্তানেরা প্রতি বছর হেমলতার জন্মদিনে তাঁর সাথে দেখা করতেন এই ভেবে যে তাঁদের মায়ের হৃদয় এখনও বেঁচে আছে। ওই অপারেশনের ছ’বছর পর মামুন মূত্রনালীর সংক্রমণে মারা যান।