বাংলাহান্ট ডেস্ক : পার্থ-অর্পিতার (SSC Scam) ফ্ল্যাটে কোটি কোটি টাকার বাণ্ডিল দেখে চোখ কপালে উঠছে? ভিরমি খেয়ে বলছেন ওর থেকে দু’একটা পেলে জীবনটা বর্তে যেত? ভাবছেন এত বড় দুর্নীতি কোনও রাজনৈতিক নেতা কখনও করেন নি? সেটা কিন্তু একদমই নয়। আজ বলবো এমনই এক রোমহর্ষক দুর্নীতির কাহিনি যার সামনে আমাদের পার্থবাবু নিতান্তই ছেলেমানুষ। আজ জানাবো ২০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির ইতিহাস।
গত ১১ মে প্রয়াত হন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুখরাম শর্মা। হিমাচল প্রদেশের রাজ্য রাজনীতির সীমানা ছাপিয়ে যিনি এক সময় পিভি নরসিংহ রাও সরকারের টেলিকমমন্ত্রী হয়েছিলেন। তবে সেই রাজনৈতিক পরিচয়কে পিছনে ফেলে তাঁর নাম বারবার ঘুরে ফিরে আসে টেলিকম দুর্নীতিতে দোষী হিসাবে।
১৯৯১ সালে ভারতে আর্থিক সংস্কারের কাণ্ডারি হিসাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাওয়ের নাম উঠে আসে। সেই সঙ্গে নাম আসে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং টেলিকমমন্ত্রী সুখরাম শর্মারও। তবে দেশের আর্থিক সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিলেও টেলিকম দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ায় ভারতীয় রাজনীতিতে চিরদিনের জন্য কলঙ্কিত নাম হয়ে রয়ে গেলেন সুখরাম শর্মা।
১৯৯৬ সালে টেলিকম ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির একাধিক মামলা দায়ের হয় সুখরামের বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়ায় যে দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় কংগ্রেস।
দুর্নীতির পাশাপাশি বারবার দলবদলেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন তিনি। কংগ্রেস থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরই হিমাচল বিকাশ মোর্চা কংগ্রেস নামে নতুন দল গড়েন সুখরাম। তারপরে ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের আগে আবারও যোগ দেন কংগ্রেসে। ২০১৭ সালে আবারও দলবদল করেন। এ বার ঘাঁটি গাড়েন বিজেপিতে।
১৯৯৬ সালের এপ্রিলে টেলিকম দুর্নীতির খোঁজ পান সিবিআই আধিকারিকেরা। তদন্তে নামে কেন্দ্রীয় সংস্থা। তাতেই সামনে আসে পাঁচ বারের বিধায়ক এবং তিন বারের সাংসদ সুখরাম শর্মার নাম।
সে সময় ডিপার্টমেন্ট অব টেলিকমিউনিকেশনস (ডট)-এর এক আধিকারিক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার কাছে ফোন করে বলেন, টেলিকম যন্ত্রপাতি সরবরাহ করার জন্য হায়দরাবাদের অ্যাডভান্সড রেডিয়ো মাস্টার্স (আর্ম) নামে এক সংস্থা-সহ ডটকে এক কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা দিয়েছে টেলিকম মন্ত্রক। এবং এ সবই হয়েছে টেলিকমমন্ত্রী সুখরামের আমলেই।
খবর শুনেই টনক নড়ে সিবিআই-এর। তৎকালীন সিবিআই প্রধান কে বিজয় রামা রাও এ নিয়ে কোনও সরকারি মেমো জারি করেননি। উল্টে আগেই আর্মের মালিকের সম্পর্কে খোঁজখবর করার নির্দেশ দেন গোয়েন্দাদের।
কোনও শিল্পপতি ছিলেন না আর্মের মালিক পাটালু রামা রাও। তিনি ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ইলেকট্রনিক কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার এক কর্মী। ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে আর্ম নামে নিজের সংস্থার প্রতিষ্টা করেন। পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯০-’৯১ সালে সাত কোটি টাকার টেলিকম যন্ত্রপাতি বিক্রি করে আর্ম। তার পরের বছর বিক্রি ১৩ গুণ হয়ে পৌঁছয় ৯০ কোটিতে। ১৯৯৩ সালে বিজয়নগর ইন্টিগ্রেটেড স্টিল প্ল্যান্ট গড়ার কথা ঘোষণা করেন। এত কম সময়ের মধ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকার ওই বিনিয়োগের তথ্য খুঁজে পান কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা।
১৯৯৬ সালের মে-জুন মাসে ফাইলের পর ফাইল তথ্য জোগাড় করেন সিবিআইয়ের আধিকারিকরা। সে সব তথ্যের বেশির ভাগই ছিল জটিল প্রযুক্তিগত শব্দে ভরা। ফলে ধাঁধার সমাধান হচ্ছিল না কোনও ভাবেই। অবশেষে সেই ধাঁধার সমাধান হয়। জানা যায় টেলিকম ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতবদল হয়ে গিয়েছে।
১৯৯৬ সালে ৮ অগস্ট সুখরাম, পাটালু রাও এবং ডটের ডিরেক্টর রুনু ঘোষের বিরুদ্ধে এফআইআর করে সিবিআই। চড়া দামে টেলিকম যন্ত্রপাতি বিক্রির অভিযোগ ছিল তাঁদের বিরুদ্ধে।
১৬ অগস্ট দিল্লির সফদরজং লেনে সুখরামের বাসভবনে হানা দেয় সিবিআই। একই সঙ্গে হিমাচল প্রদেশের মান্ডিতে তাঁর বাড়িতেও চলে অভিযান। দিল্লিতে উদ্ধার হয় প্রায় আড়াই কোটি টাকা। মান্ডির বাড়িতে ২২টি স্যুটকেস এবং ট্রাঙ্কে ভরে রাখা ছিল নগদ টাকা। মান্ডিতে পুজোর ঘরে বিগ্রহের পিছন থেকে উদ্ধার হয় এক কোটি ১৬ লক্ষ টাকা। কী ভাবে এই টাকা এল, তার উত্তর দিতে পারেননি সুখরামের মেয়ে।
একই দিনে রুনু ঘোষের বাড়ি থেকে নগদে এক কোটি ৩২ লক্ষ টাকা উদ্ধার করে সিবিআই। সেই সঙ্গে এক কেজি সোনা এবং এক লক্ষ টাকা অর্থমূল্যের বিদেশি মুদ্রাও মজুত ছিল তাঁর বাড়িতে। ওই সময়ই হায়দরাবাদের আর্মের দফতর থেকে প্রচুর নথিপত্র-সহ অনেক টাকা উদ্ধার করা হয়।
জানা যায়, ২১টি টেলিকম সার্কলের জন্য ১৬টি সংস্থা দরপত্র জমা দেয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ দেওয়ার কথা বলে হিমাচল ফিউচারিস্টিক কমিউনিকেশনস (এইচএফসিএল), ইজরায়েলি সংস্থা বেজেক এবং তাইল্যান্ডের সিনাবাত্রা। সব মিলিয়ে ৮৫ হাজার কোটি টাকা দাম ওঠে।
সুখরামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে হরিয়ানা টেলিকম লিমিটেড (এইটিএল)-কে টেলিকম চুক্তি পাইয়ে দেওয়ার জন্য তিন লক্ষ টাকা ঘুষ নেন। ওই সংস্থাটি ৩০ কোটি টাকার কেবল পাতার চুক্তি পায়। ওই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে পাঁচ বছরের জেল হয় সুখরামের। তবে সুখরামের বাড়ি থেকে উদ্ধার হওয়া কোটি কোটি টাকার উৎস কী? সে জবাব এখনও অজানা সিবিআইয়ের।