বাংলা হান্ট ডেস্কঃ আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজ্যে বিশেষ কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে বিজেপি (BJP)। দলীয় নেতৃত্বের হিসাব বলছে, বাংলার মোট ১৪১টি আসনকে ‘পাখির চোখ’ করছে গেরুয়া শিবির। এই আসনগুলিতেই গত তিনটি বড় নির্বাচনের (২০১৯ সালের লোকসভা, ২০২১ সালের বিধানসভা এবং ২০২৪ সালের লোকসভা) অন্তত একবার বিজেপি এগিয়ে ছিল। বিজেপির বিশ্বাস, এই আসনগুলিতে বিশেষ নজরদারি ও সংগঠিত প্রচার চালালে জয়ের রাস্তা খুলতে পারে।
কোথায় ‘শক্ত ঘাঁটি’, কোথায় ‘দোদুল্যমান’?
দলীয় তথ্য বিশ্লেষণ বলছে, ১৪১টি আসনের মধ্যে মোটামুটি ৬০টি আসনকে বিজেপি (BJP) নিজেদের ‘শক্ত ঘাঁটি’ বলে মনে করছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ধরা হচ্ছে সেই ৫২টি আসনকে, যেখানে তিনটি নির্বাচনেই বিজেপি অন্যদের থেকে এগিয়ে ছিল। আরও ৭টি আসন রয়েছে, যেখানে ২০১৯ সালে তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও ২০২১ ও ২০২৪-এ বিজেপি পাল্টা সাফল্য দেখিয়েছে। এই আসনগুলি মূলত পূর্ব মেদিনীপুরে। ২০২০ সালে শুভেন্দু অধিকারীর বিজেপিতে যোগদানের পর আসনগুলি তৃণমূল থেকে বিজেপিতে স্থানান্তরিত হয়।
অন্যদিকে, ৪৭টি আসনকে ‘দোদুল্যমান’ বলে চিহ্নিত করছে গেরুয়া শিবির। এদের মধ্যে রয়েছে ২৩টি আসন, যেখানে ২০১৯ ও ২০২৪-এ এগোলেও ২০২১ সালে হেরেছে বিজেপি। আবার ১২টি আসনে ২০১৯ ও ২০২১ সালে এগোলেও ২০২৪ সালে পিছিয়ে পড়ে। এছাড়া ৯টি আসনে বিজেপি প্রথমবার এগোয় ২০২৪-এ। তবে ৩টি আসনে ২০২১ সালের জয় ২০২৪ সালে ধরে রাখতে পারেনি বিজেপি (BJP)। এছাড়া অবশিষ্ট ৩৫টি আসনে বিজেপি ২০১৯ সালে একবার এগোলেও পরে আর সেই সাফল্য ধরে রাখতে পারেনি। ফলে সেগুলিকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করছে দল।
আরও পড়ুনঃ শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, ১৮ টি দপ্তরে নতুন পদ তৈরির সিদ্ধান্ত রাজ্যের, কোন কোন দপ্তরে?
বিজেপির (BJP) ‘শক্ত ঘাঁটি’র ভাণ্ডার কোথায় সবচেয়ে বেশি?
বিজেপির (BJP)‘শক্ত ঘাঁটি’র ভাণ্ডার সবচেয়ে বেশি উত্তরবঙ্গেই। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর, মালদহ, এই সব জেলায় বিজেপি ধারাবাহিক সাফল্য দেখিয়েছে। এছাড়া, কোচবিহারের মাথাভাঙা থেকে নাটাবাড়ি, আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটা থেকে মাদারিহাট, জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি, সব জায়গাতেই রয়েছে গেরুয়া দাপট।
দক্ষিণবঙ্গেও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি রয়েছে। সেগুলোই হল, নদিয়া ও উত্তর ২৪ পরগনার মতুয়া অধ্যুষিত আসনগুলি যেমন বনগাঁ উত্তর-দক্ষিণ, গাইঘাটা, রানাঘাট, চাকদহ, কল্যাণী, হরিণঘাটা। এই এলাকাগুলি বিজেপির কাছে শক্ত জমি হিসেবে চিহ্নিত। এছাড়া গত তিনবারের ভোটে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর, পশ্চিম বর্ধমান জেলাগুলির সীমান্তবর্তী আসনগুলিও গেরুয়া শিবিরের দখলে ছিল।
পূর্ব মেদিনীপুরে বিজেপির (BJP) একমাত্র ভরসা শুভেন্দু
পূর্ব মেদিনীপুরের ময়না, নন্দীগ্রাম, হলদিয়া, খেজুরি, কাঁথি উত্তর-দক্ষিণ, ভগবানপুরের আসনে বিজেপি পরপর দু’বার এগিয়েছে। বিশেষত অধিকারী পরিবারের রাজনৈতিক প্রভাব এখানে বিজেপিকে মজবুত করেছে।
দোদুল্যমান আসনের লড়াই
বিজেপির (BJP) ৪৬টি দোদুল্যমান আসনের মধ্যে কয়েকটি নজরকাড়া আসন রয়েছে। যেমন জলপাইগুড়ির ধুপগুড়ি, দার্জিলিঙের কালিম্পং, নদিয়ার শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর দক্ষিণ, কলকাতার শ্যামপুকুর, হুগলির চুঁচুড়া, পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা ও পাঁশকুড়া, পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি ইত্যাদি। এছাড়া এমনও আসন আছে, যেখানে বিজেপি ২০২৪ সালে প্রথম এগিয়েছে, যেমন মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুর, বড়ঞা, উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালি, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, চণ্ডীপুর, মহিষাদল প্রভৃতি।
২০১৯ সালে বিজেপি (BJP) ১৮টি লোকসভা আসন জিতে ৪০.৬% ভোট পায়। কিন্তু ২০২১-এ ভোটের হার কিছুটা কমে যায়, সঙ্গে আসনসংখ্যায় বিপর্যয় নেমে আসে। ২০২১ এর ভোট মাত্র ৭৭টি আসন পায় বিজেপি। ২০২৪-এ আবার কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও সাফল্য ২০১৯-এর কাছাকাছি পৌঁছয়নি। ফলে আগামী বিধানসভায় গরিষ্ঠতার (১৪৮ আসন) লক্ষ্যে পৌঁছনো বিজেপির জন্য বেশ কঠিন।
গত তিনটি নির্বাচনে বিজেপির ভোট শতাংশ ঘুরপাক খাচ্ছে ৩৮.৫% থেকে ৪০.৬% এর মধ্যে। অন্যদিকে তৃণমূলের ভোটশক্তি প্রায় ৪৩.৭% থেকে ৪৮.৫%। তাই আগামী বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছতে বিজেপিকে ভোটের হার ও আসন সংখ্যা, দুইয়ি বাড়াতে হবে।
বিজেপির (BJP) অন্যতম ‘শক্ত ঘাঁটি’ হল মাতুয়া ভোট
বিজেপির (BJP) অন্যতম ‘শক্ত ঘাঁটি’ হল মতুয়া ভোট। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় সেই সমর্থনে ফাটল ধরতে শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জন বার্লার দলত্যাগ, মতুয়া পরিবারকে অন্য রাজ্যে ‘বাংলাদেশি’ সন্দেহে হেনস্থার ঘটনা, এমনকি শান্তনু ঠাকুরের সই করা পরিচয়পত্র অকার্যকর হয়ে পড়া বিজেপির জন্য বড় ধাক্কা। এর পাশাপাশি, নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (CAA) বলবৎ হলেও নথিপত্র সমস্যার কারণে বহু উদ্বাস্তু আবেদন করতে পারছেন না। এতে মতুয়া ভোট কতটা গেরুয়া শিবিরের দিকে থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
‘দোদুল্যমান’ আসনের মধ্যে বেশ কিছু মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনও আছে। যেমন- করণদিঘি, রায়গঞ্জ, মানিকচক, বৈষ্ণবনগর, জঙ্গিপুর, বড়ঞা, তেহট্ট ইত্যাদি। বিজেপি এগিয়েছে মূলত তৃণমূল ও বাম-কংগ্রেসের ভোট ভাগাভাগির কারণে। তবে সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে মুসলিম ভোট এককাট্টা হয়ে গেলে এই আসনগুলি ফের তৃণমূলের দখলে যেতে পারে বলে চিন্তা দলের।
আগামী বিধানসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছানোর জন্য কলকাতা ও তার আশেপাশের শহরে শাসক দলের দুর্নীতি, কর্মসংস্থান, প্রতিষ্ঠানবিরোধী ক্ষোভ, এসবকে হাতিয়ার করতে চাইছে বিজেপি (BJP)। অনেকের মতে, আগে কখনও এগিয়ে না থাকা কিছু শহরে অপ্রত্যাশিত ফল করতে পারে গেরুয়া শিবির। তবে এর জন্য তাদের বাম-কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নামতে হবে। সেই কারণেই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব বামবিরোধী আক্রমণ জোরদার করছে।
আরও পড়ুনঃ দশ বছরের প্রতীক্ষার অবসান! অবশেষে ১২৪১ উচ্চ প্রাথমিক প্রার্থীর পক্ষে বড় রায় ঘোষণা করল হাই কোর্ট
সব মিলিয়ে বিজেপি (BJP) মনে করছে, এই ১৪১ আসনের মধ্যে ১০৬টি তাদের কাছে সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। তবে ২০১৯-এ একবার এগোলেও পরের দুই ভোটে হারতে থাকা ৩৫টি আসনকেও গুরুত্ব দিচ্ছে তারা। যদিও রাজনীতির অঙ্কে যে কোনও সময় হিসেব বদলে যেতে পারে। তবে ২০২৫-২৬ সালের ভোটে এই আসনগুলিই নির্ধারণ করবে বাংলার গেরুয়া ভাগ্য।