রাজা সাহা :-পরদিন বাসে করে রওয়ানা দিলাম ৩৮৭ কিমি দূরে ১২৫৩০ ফুট উঁচু ‘কোলাও’ মালভূমির মূল শহর ‘পুনো’র উদ্দেশ্যে । বিস্তীর্ণ মালভূমি জুড়ে চোখে পরলো ‘লামা’ ও ‘আলপাকা’ নামের গৃহপালিত মেরুদণ্ডী রোমন্থক অসংখ্য প্রাণীর । মূলত মাল বহন করার কাজে ব্যবহৃত এই দুই প্রাণীদ্বয়ের মাংস নাকি অতি সুস্বাদু ।
১৮০০০ ফুট উঁচু বরফ ঢাকা ‘চিম্বোয়া’ পর্বতকে পাশে রেখে ‘লা রায়া’ গিরিপথ অতিক্রম করলাম – পথের ধারে পেয়ে গেলাম ছোট্ট এক লেক (নাম মনে নেই – সম্ভবত ‘লেঙ্গি’ ) । চলে এলাম ‘রাকচি’ নামের ছোট প্রাচীন এক শহরে – ইনকা সভ্যতার ‘উইরাকোচা’ মন্দির আর ‘আণ্ডাহুয়ায়লিলাস’ চ্যাপেল দেখলাম । স্থানীয় লোকজনের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হতে হয় – কিছু না কিনলেও এখানকার পানীয় গরমাগরম কোকা চা আপনাকে খাওয়াবেই । গাইডের অলটিমিটারে ১৫৩০০ ফুট উচ্চতা দেখে বেশ ঘাবড়ে গেলাম । প্রায় দশ ঘণ্টার যাত্রা শেষে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে পুনোর হোটেলে ঢুকলাম ।
লেক টিটিকাকা দেখতে পরদিন সকালে চলে এলাম পুনো জেটিতে । ১২৫০০ ফুট উচ্চতায় ‘অ্যণ্ডিজ’ পর্বতমালায় বলিভিয়া এবং পেরু দুই দেশে এই লেকের অবস্থান – গড় গভীরতা ১০০ মিটার, উপরিভাগের ক্ষেত্রফল প্রায় ৩৩০০ স্কোয়ার কিমি । ছোটবড় ৪২টা দ্বীপ ছাড়াও এই লেকে আছে স্থানীয় মানুষদের সৃষ্ট গোটাকয়েক কৃত্রিম দ্বীপ । লেকের অগভীর জলায় প্রচুর পরিমাণে গজিয়ে ওঠা ‘টোটোরা’ নামের এক ধরণের ভাসমান খাগড়ার ওপরের পরত দিয়ে ‘উরোস’ উপজাতিদের দ্বারা নির্মিত একটা ছোট কৃত্রিম দ্বীপে চলে এলাম । ‘লেক টাউন’ নামেও এই দ্বীপ পরিচিত । প্রায় ৬০টা এধরনের কৃত্রিম দ্বীপমালায় বর্তমানে প্রায় হাজার খানেক মানুষ বসবাস করে ।
দ্বীপগুলো আবার প্রয়োজনে সচল । এক একটা দ্বীপে দু তিনটে কুঁড়েঘরে এক একটা যৌথ পরিবার বসবাস করে । দ্বীপমালা অধুনা পর্যটকদের আকর্ষণের উৎস । আর তাই মাছ ধরা ও শিকার করার সাথে হস্তশিল্পের বিভিন্ন সামগ্রী বিক্রিও বর্তমানে এই উপজাতিদের আয়ের অন্যতম উৎস । উচ্চতার কারণে এই লেকের জল বেশ ঠাণ্ডা । ২০০০ খৃষ্টাব্দে প্রত্নতাত্ত্বিকরা জলের গভীরে এক মন্দিরের সন্ধান পান । এই লেকে বহু ধরণের জলপাখীর দেখা পাওয়া যায় । লেকের জলে পাওয়া যায় অসংখ্য বিপন্ন ‘জল-ব্যাঙ’ এবং উড়তে অক্ষম ছোট ডুবুরি পাখি । এ ছাড়াও প্রায় ৫৩০ প্রজাতির জলজ প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যায় এই লেকের জলে । আমাদের মোটরবোট এবার রওয়ানা দিলো এই লেকের আর এক দর্শনীয় স্থান ‘ট্যাকিলা’ দ্বীপের উদ্দেশ্যে ।
লেকের ভিতর দিয়ে ৪৫ কিমি গিয়ে দেখা পাওয়া যায় – সরু ও লম্বাটে এই পাহাড়ি দ্বীপ – স্প্যানিশ আামলে জেলখানা হিসাবে ব্যবহৃত হত । জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২২০০ । দ্বীপের উচ্চতম স্থান প্রায় ১৩২৯০ ফুট । মোটরবোট চালকের কাছ থেকে এসব শুনতে শুনতে খেয়ালই ছিল না যে লেকের জল কখন উদ্দাম হয়ে উঠেছে – বড় বড় ঢেউয়ের দোলায় মোটরবোট ভীষণভাবে দুলছে ।
আমরাও ভীষণ টলটলায়মান । পৌঁছতে এখনও ঘণ্টা খানেক লাগবে । একটু পরেই ওয়ারলেস মারফত চালকের কাছে মেসেজ এলো সামনের অবস্থা আরও দুর্যোগপূর্ণ – সকালের দিকে যে দুটো মোটরবোট টুরিস্ট নিয়ে গেছে সে দুটো ফিরতে পারছে না । ঐ দ্বীপেই রাত কাটাতে বাধ্য হবে । সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম – ঝুঁকি নেওয়াটা ঠিক হবে না । যাত্রা বাতিল করে ফিরে এলাম জেটিতে ।
ঝামেলার ওপর ঝামেলা । হোটেলে ফিরে খবর পেলাম পরের দিন পুনোতে সকাল ৬টা থেকে ১২ ঘণ্টা ব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট – যান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ । পুনো শহরের চারপাশের অসংখ্য খনি থেকে মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাদের আকরিক পদার্থ বাছবিচারহীন আহরণের ফলে এই শহরের পরিবেশ ভীষণ ভাবে দূষিত হওয়ার প্রতিবাদে এই ধর্মঘট । সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম অগত্যা আমরা ভোর চারটেয় এই শহর ছেড়ে ৫০ কিমি দূরের ‘হুলিয়ানা’ বিমানবন্দরে গিয়ে পরবর্তী গন্তব্য স্থল লিমা যাওয়ার বিমান ধরার জন্য অপেক্ষা করবো । তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলাম ।
প্যাক্ট ব্রেকফাস্ট নিয়ে সকাল ৬টায় পৌছে গেলাম – প্লেন ছাড়বে বেলা দেড়টায় । বেলা একটু বাড়লে ছোট এই বিমানবন্দরে ঢোকার মুখে স্থানীয় লোকজনের দু একটা দোকান খুলল – কফি, কমদামী বিস্কুট, ডিম সেদ্ধ, ওমলেট এসব পাওয়া যাচ্ছে । সবাই মিলে দলবেঁধে হাজির হলাম দোকানে – নিমেষে দূর হয়ে গেলো ভাষার অন্তরায় । চা কফি খেয়ে আড্ডা মেরে সময় কাটিয়ে দিলাম । প্যাসিফিক মহাসমুদ্রের পাড়ে অবস্থিত লিমা অথচ এই মহাসমুদ্র দেখবো না এটা মেনে নিতে মন চাইলো না । লিমা বিমানবন্দর থেকে দলবেঁধে সোজা সমুদ্র সৈকতে চলে এলাম । প্লাস্টিকের ওয়াটার বটলে দু একজন জল সংগ্রহ করলো । গামছা তোয়ালে সম্বল করে অতি উৎসাহীরা আর এক প্রস্থ স্নান সেরে নিলো প্যাসিফিকের জলে । বিকেলের দিকে ফিরে এলাম লিমা শহরের সেই হোটেলে ।