২২ টি কক্ষের রহস্য! জেনে নিন কখন এবং কেন বিবাদ শুরু হয় তাজমহলকে নিয়ে

বাংলা হান্ট ডেস্ক: ইতিমধ্যেই তাজমহলকে নিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের লখনউ বেঞ্চে আবেদন করেছেন অযোধ্যার বিজেপি নেতা ড. রজনীশ সিং। তিনি তাঁর পিটিশনে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া (এএসআই)-এর কাছে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ তাজমহলের ২২ টি কক্ষ খুলে একটি সার্ভের দাবি জানিয়েছেন। মূলত, তিনি মনে করেছেন যে, তাজমহলে হিন্দু দেব-দেবীর মূর্তি এবং শিলালিপি থাকতে পারে। আর সেই কারণেই সার্ভের প্রয়োজন রয়েছে বলে দাবি জানান তিনি।

তবে, তাজমহল নিয়ে এই প্রথমবার বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছেনা। বরং, এর আগেও বহুবার দাবি করা হয়েছে যে, মন্দির ভেঙে তাজমহল তৈরি করা হয়েছে। বর্তমান প্রতিবেদনে এই সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপিত করা হল।

তাজমহলের কক্ষগুলি ১৯৩৪ সালে খোলা হয়:
এই প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক তথা অধ্যাপক ডা. এসপি ভার্মা জানিয়েছেন, তাজমহলে সমাধির নিচে ২২ টি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। সেইসব কক্ষগুলিকে নিয়েই বারংবার প্রশ্ন উঠেছে। ভার্মা বলেছেন যে, শেষবার এই কক্ষগুলি ১৯৩৪ সালে খোলা হয়।

তাজ বিতর্ক কবে শুরু হয়েছিল?
এই প্রসঙ্গে আরেক ঐতিহাসিক তথা অধ্যাপক ড. বিজয় বাহাদুর জানিয়েছেন, “এটা ৬০ অথবা ৭০ দশকের কোনো এক সময়। তৎকালীন ইতিহাসবিদ পিএন ওক একের পর এক প্রবন্ধ লিখতে থাকেন এই নিয়ে। সেগুলিতে তাজমহল নিয়ে বিভিন্ন দাবি করা হয়। পরে তাঁর তাজমহল নিয়ে দু’টি বইও প্রকাশ পায়। একটির নাম ছিল ‘True Story of Taj’ এবং অন্যটির নাম ছিল ‘The Taj Mahal is Tejo Mahalaya – A Shiva Temple’। এতে তিনি দাবি করেন যে তাজমহল একটি শিব মন্দির, যা তেজো মহালয় নামে পরিচিত ছিল।”

শুধু তাই নয়, ওক আরও দাবি করেছেন যে, তাজের ভিতরে যদি তদন্ত এবং খনন করা হয় তবে তাঁর কথা একেবারেই সঠিক বলে প্রমাণিত হবে। সেই সময়ে, ওক আগ্রার লাল কেল্লা, কাবা সহ অনেক ঐতিহাসিক স্থানকেও হিন্দুদের দ্বারা তৈরি ভবন বলে দাবি করেছিলেন। পাশাপাশি আরও জানিয়েছিলেন যে, মুসলিম আক্রমণকারীরা এগুলি ক্রমাগত আক্রমণ করে গিয়েছে।

ঠিক কি যুক্তি দিয়েছিলেন ওক?
পিএন ওক তাঁর “ট্রু স্টোরি অফ দ্য তাজ”- বইতে লিখেছেন, “এটি ছিল একটি শিব মন্দির বা রাজপুতানা প্রাসাদ। যা শাহজাহান দখল করে একটি সমাধিতে রূপান্তরিত করেছিলেন।” পাশাপাশি, তিনি আরও বলেন, তাজমহল থেকে হিন্দু অলঙ্করণ এবং প্রতীকগুলি সরানো হয়েছিল এবং যেখানে যেখানে এগুলি সরানো যায়নি সেখানে এগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়।” ওকের মতে, যে কক্ষে সেই বস্তুগুলি এবং মূল মন্দিরের শিব লিঙ্গ লুকিয়ে আছে সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে৷

তিনি তাঁর বইতে আরও দাবি করেছেন যে, মমতাজকে তাঁর কবরে শায়িত করা হয়নি। এমনকি, এই দাবির সমর্থনে ওক যমুনা নদীর পাশে তাজমহলের কাঠের দরজার কার্বন ডেটিং-এর ফলাফলও দিয়েছেন। এছাড়াও, তিনি জানান, তাজমহল হল “তেজোমহালয়” শব্দের অপভ্রংশ। যা শিব মন্দিরকে নির্দেশ করে। তেজোমহালয় মন্দিরে অগ্রেশ্বর মহাদেব পূজিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।

বিতর্ক কখন বাড়ল?
২০১৫: লখনউয়ের হরিশঙ্কর জৈন তাজমহলকে ভগবান শ্রী অগ্রেশ্বর মহাদেব নাগনাথেশ্বরের বিরাজমান তেজো মহালয় মন্দির হিসাবে ঘোষণা করার জন্য আগ্রার সিভিল কোর্টে একটি আবেদন করেছিলেন। এর ভিত্তিতে বটেশ্বরে পাওয়া রাজা পরমর্দিদেবের শিলালিপির প্রসঙ্গও উপস্থাপিত করা হয়। যদিও, ২০১৭ সালে, কেন্দ্রীয় সরকার এবং এএসআই পাল্টা দাবি জানিয়ে তাজমহলে কোনও মন্দির বা শিবলিঙ্গ থাকা বা এটিকে তেজো মহালয় হিসাবে বিবেচনা করার কথা অস্বীকার করে। তবে, বিষয়টি এখনও বিচারাধীন রয়েছে।

২০১৭: যখন যোগী আদিত্যনাথ উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তখন রাজ্যসভার সাংসদ বিনয় কাটিয়ার, তাজমহলের বিষয়টি ফের উত্থাপন করেছিলেন। এমনকি, অযোধ্যায় শ্রী রাম জন্মভূমি আন্দোলনেও এগিয়ে ছিলেন তিনি।

২০২২: মার্চ মাসে, অযোধ্যা তপস্বী শিবিরের সাথে যুক্ত সাধক জগদগুরু পরমহংসাচার্য আগ্রা গিয়েছিলেন। সেই সময় তিনি অভিযোগ করেছিলেন যে, একটি বিশেষ ধরনের পোশাক পরার কারণে তাঁকে তাজমহলে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। পরে পরমহংসাচার্যও বলেছিলেন যে, এই তাজমহল মূলত তেজো মহল।

আবেদনে কি দাবি করা হয়েছে?
বিজেপি নেতা ডা. রজনীশ সিং, ইতিমধ্যেই হাইকোর্টে একটি পিটিশন দাখিল করে জানিয়েছেন যে, ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে আসা সমস্ত ভ্রমণকারীরা তাঁদের ভ্রমণ স্মৃতিতে রাজা মানসিংহের প্রাসাদের বর্ণনা করেছেন। তাজমহল ১৬৫৩ সালে নির্মিত হয়েছিল এবং ১৯৫১ সালে ঔরঙ্গজেবের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়েছিল। যেখানে তিনি লেখেন “আম্মির সমাধিটি মেরামত করা দরকার।”

dda0171eda6ba074bec60748f9160cff original

কথিত আছে, এই তেজোমহল রাজা মান সিংহের ছিল। জয়পুরের সিটি প্যালেস মিউজিয়ামে এই সম্পর্কিত একটি শিলালিপি রয়েছে। যেখানে উল্লেখ আছে যে, রাজা মান সিংহের প্রাসাদের বিনিময়ে শাহজাহান রাজা জয় সিংকে চারটি প্রাসাদ দিয়েছিলেন। ১৬৩৩ সালের ১৬ ডিসেম্বরে এই ফরমান জারি করা হয়। এতে রাজা ভগবান দাসের প্রাসাদ, রাজা মাধো সিংহের প্রাসাদ, রূপসী বৈরাগীর প্রাসাদ এবং সুরজ সিংয়ের ছেলে চাঁদ সিং-এর প্রাসাদের কথা উল্লেখ আছে। এছাড়াও, শাহজাহানের ফরমানে উল্লেখ আছে যে তিনি জয় সিংয়ের কাছ থেকে মার্বেল অর্ডার করেছিলেন। এই পত্রটিকেই প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করে দাবি করা হয় যে, শাহজাহান যে পরিমাণ মার্বেল চেয়েছিলেন তা দিয়ে তাজমহলের নির্মাণ করা সম্ভব ছিলনা।

Sayak Panda
Sayak Panda

সায়ক পন্ডা, মেদিনীপুর কলেজ (অটোনমাস) থেকে মাস কমিউনিকেশন এবং সাংবাদিকতার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করার পর শুরু নিয়মিত লেখালেখি। ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা হান্ট-এর কনটেন্ট রাইটার হিসেবে নিযুক্ত।

সম্পর্কিত খবর