বাংলা হান্ট ডেস্ক: যার মুখে ‘চড়াম চড়াম’ সেই এখন সামান্য ‘গুড় বাতাসা’টুকুও পাচ্ছেন না। তৃণমূলের ‘খেলা হবে’ গানের শব্দ যার মুখ থেকে নেওয়া, এবার তার সঙ্গেই খেলা হচ্ছে না তো? না আমরা নই, তৃণমূলের (Trinamool Congress) ৩২ তম ২১ জুলাইয়ের পর এমনটাই প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। কারোর বুঝতে বাকি নেই এখানে কথা হচ্ছে, অনুব্রত মণ্ডল (Anubrata Mondal) ওরফে কেষ্টকে নিয়ে। বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা জেলের থেকে বেরোলোও আপাতত রয়েছেন রাজনীতির জালে। কৃষক পরিবারের ছেলে কেষ্ট কীভাবে তৃণমূলের ‘বাঘ’ হয়ে উঠল, আর কবেই না বাঘ থেকে বিড়াল হয়ে গেলেন?
কেষ্ট কাহিনী
শিক্ষাগত যোগ্যতা বলতে এইট (অষ্টম শ্রেণি) পাশ। অল্প বয়সেই পড়াশোনা ছেড়ে হাত লাগান বাবার মুদি দোকানে। সেখান থেকে পরে অন্য ছোটোখাটো কাজ করেন। গ্রিলের দোকান ছিল তাঁর। শোনা যায় একসময় বাজারে মাছ বিক্রেতা করতেন অনুব্রত। তবে তা শোনা কথা মাত্র। বাবার দোকান, নিজের ব্যবসার ফাঁকেই গায়ে লাগে রাজনীতির ছোঁয়া।
মুদির দোকানী থেকে তৃণমূলের ‘বাঘ’ হয়ে ওঠার কাহিনী
সেই সময় বাম জমানা। সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কংগ্রেসের পতাকা হাতে তুলে নেন অনুব্রত। মাঝে টুক করে বিয়েও সেরে নেন। ১৯৯১ সালের আশেপাশের ঘটনা হবে। অনুব্রত যখন হাত শিবিরে ছিলেন তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কংগ্রেস করতেন। বর্তমান ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্প মন্ত্রী চন্দ্রনাথ সিনহার সঙ্গে ভালো দোস্তি ছিল অনুব্রতর। সূত্রের খবর দুজনায় একসাথে জমি বেচাকেনার ব্যবসা করতেন। সেই থেকেই পরে কংগ্রেস ছেড়ে নাম লেখান তৃণমূলে। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তৃণমূলেরই ‘সৈনিক’ অনুব্রত।
ধীরে ধীরে রাজনীতিতে আগ্রহ বাড়ে কেষ্টর। একজন সাধারণ কর্মী হিসেবেই সক্রিয় হয়ে ওঠেন অনুব্রত। সেই সময় নানুর গণহত্যার কাণ্ডে ঝাঁঝালো আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন অনুব্রত। তাঁর ইয়ং লড়াকু স্বভাব চোখ এড়ায়নি তৃণমূল সুপ্রিমোর। একজন সাধারণ কর্মী থেকে শুরু করে ২০০০ সালে রাজ্য স্তরে উঠে আসেন কেষ্ট।
কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূলের জন্ম, এল কেষ্টও
১৯৯৮ সালে জাতীয় কংগ্রেস ভেঙে মমতা যখন তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন জেলা যুব তৃণমূল সভাপতি দায়িত্ব পান অনুব্রত। পরে বীরভূমে কেষ্টর হাত শক্ত করতে জেলা তৃণমূল সভাপতির দায়িত্বে বসানো হয় তাঁকে। ২০০৩ সালের ঘটনা। বীরভূমের নানুরের হাট সেরান্দি গ্রামের এক সাধারণ ছেলে হয়ে ওঠেন মমতার স্নেহের কেষ্ট।
কেষ্ট জেলা সভাপতি দায়িত্ব পেতেই বদলে যায় বীরভূমের ভোল। বামেদের দুর্গ হিসাবে পরিচিত বীরভূম হয়ে যায় সবুজে সবুজ। ২০১১ সালে বামেদের পরাজিত করে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। সেই সময়ই জেলায় নিজের দাপট দেখাতে শুরু করেন দোর্দন্ড প্রতাপ নেতা অনুব্রত মণ্ডল। তাঁর নির্দেশে বীরভূমে বাঘে গরুতে একঘাটে জল খেতে শুরু করে। গাছের পাতাও যেন কেষ্টর পারমিশন না নিয়ে নড়তে ভয় পেত সেই সময়।
কখনও ‘কবজি কেটে নেব’। কখনও পুলিশের গাড়িতে ‘বোম’ মারার মত মন্তব্য, রেয়াত পেতেন না পুলিশকর্তারাও। কার্যত বীরভূমের বেতাজ বাদশা হয়ে ওঠেন কেষ্ট। যত তার দাপট বাড়ে ততই জুড়তে থাকে দুর্নীতি, হিংসার ঘটনায় নাম। ভোট পরবর্তী হিংসা সহ বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে পড়েন কেষ্ট। বাদ যায়নি গরু পাচার, কয়লা পাচারও।
পঞ্চায়েত ভোট থেকে বিধানসভা ভোট, শয়ে-শয়ে বিরোধী কর্মী খুনের অভিযোগ বীরভূমে। তবে সেসব কেষ্টর জায়গা বিন্দুমাত্র টলাতে পারেনি। উল্টে যত দিন যায় কেষ্টর দাপট বাড়তে থাকে। সবমিলিয়ে ভালোই চলছিল কেষ্ট রাজত্ব। তবে তাল কাটে ২০২২ সালে। গরুপাচার-কাণ্ডে ১০ বার অনুব্রতকে তলব, তারপরই তাঁকে গ্রেফতার করে সিবিআই। সেই থেকে গোটা গল্পটাই যেন ওলোটপালোট হয়ে যায়।
আরও পড়ুন: নন্দীগ্রামে দোকানদারকে তৃণমূল বিধায়কের হুমকি! ফেসবুক পোস্টে মমতাকে একহাত নিল শুভেন্দু
গল্পে টুইস্ট
২০২২ সালের আগস্ট মাসে বীরভূমের তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে গরুপাচার মামলায় গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। প্রথমে আসানসোল সিবিআই আদালতে এই মামলা চলে। সেখানেই সংশোধনাগারে বন্দি ছিলেন তৃণমূল নেতা। এরপর তিহাড় জেলে দিল্লিতে নিয়ে আসা হয় অনুব্রতকে। সেখানে তাকে গ্রেফতার করে ইডিও। জেলে গিয়ে ওজন (দুই অর্থেই), ভোজন দুই-ই কমে কেষ্টর।
২০২২ সালের অগস্ট মাসে অনুব্রত (Anubrata Mondal) গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই তদন্তকারীদের নজরে ছিলেন সুকন্যা। এরপর কেষ্ট গ্রেফতারির সাড়ে আট মাস পর সুকন্যাকে গ্রেফতার করেছিল ইডি। এই সময়ের মধ্যে অনুব্রত মণ্ডলের কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সব বাজেয়াপ্ত করে ইডি। ‘সর্বস্বান্ত’ হন কেষ্ট। তবে জেলে থাকলেও কেষ্টর বিশ্বাস ছিল তৃণমূলে, ভরসা ছিল দিদির উপর। জেলে যাওয়ার পরও মুখ্যমন্ত্রীর মুখে বার বার শোনা গিয়েছে কেষ্ট নাম।
ফিরলেও আগের জায়গা নেই!
গত বছর পুজোর আগে আগে জেল থেকে জামিন পান কেষ্ট। তবে এই সময়ের মধ্যে বদলে যায় অনেক কিছু। জেলে থাকাকালীন তৃণমূল কেষ্টর পদে কাউকে না বসালেও সম্প্রতি সেই পাট চুকেছে। বিতর্ক এড়াতে বীরভূম জেলা তৃণমূলের সভাপতির পদই তুলে দিয়েছে তৃণমূল। বর্তমানে পদহারা কেষ্ট। আর এই অবস্থায় ফের পুলিশকে ‘দাদাগিরি’ দেখাতে গিয়ে দলের কোপে পড়েছেন কেষ্ট। কার্যত বুমেরাং!
আরও পড়ুন: হাইকোর্টের রায়কে সরাসরি চ্যালেঞ্জ রাজ্যের! ওবিসি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ কপিল সিব্বলরা
যেই পুলিশকে চোখ রাঙাতে দুবার ভাবতেন না কেষ্ট, ২১ জুলাইয়ের আগের সন্ধ্যায় সেই পুলিশই ধর্মতলায় কেষ্টকে আটকে দিল। এমনকী মূল মঞ্চের কাছে পৌঁছোনোর অনেক আগেই আটকে দেওয়া হয় তাঁকে।দিদির দর্শনে ছুটে গেলেও দেখা পেলেন না। আর পরদিন কেষ্টরও দেখা পেলেন না কেউ। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মঞ্চের নীচে বা মঞ্চের পিছনে কোথাও দেখা যায়নি তৃণমূলের কেষ্টকে। না তাঁর নাম নেন মুখ্যমন্ত্রী। তাহলে কী পরিস্থিতি বুঝে কেষ্টকে দল থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে দল। তা আপাতত পরিষ্কার না হলেও, এই কেষ্টই যে ‘বীরভূমের বাঘ’ বলে পরিচিত ছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতি দেখে তা বোঝা দায়।