‘গুমনামী” সিনেমার রিভিউ, কলমে সৌতিক চক্রবর্তী।
সৌতিক চক্রবর্তী,বাংলাhunt :- কাল হঠাৎ করে চলে গেলাম বোলপুর গীতাঞ্জলি সিনেমা হল। ‘গুমনামী’ সিনেমা দেখতে। বিকেল ৪:৫ থেকে শুরু হবে এই সিনেমা।তুবুও আমি দুপুর ৩ টে তেই হাজির হয়েছিলাম। হলে ঢুকেই প্রথমে টিকিট কাউন্টারে ১১০ টাকা দিয়ে ব্যালকনির টিকিট কেটে নিলাম হাউস ফুলের ভয়ে। তারপর পকেট থেকে ফোন বের করে ‘গুমনামী’ ব্যানারের সামনে সেলফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করলাম। তারপর প্রায় বিকেল ৪:১৫ তে সিনেমা শুরু হলো। সিনেমার শুরুতেই হলে বড়ো স্ক্রিনের সামনে ভেসে উঠলো জাতীয় পতাকার ছবি ও বেজে উঠলো জাতীয় সংগীত। হল ভর্তি সবকটা লোক সবাই মিলে একযোগে সিট্ ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে সংগীত শুনলো।
এরপর আসি সিনেমার কথায়,
নেতাজি সুভাষ কি সত্যিই ১৯৪৫-এর ১৮ অগস্ট প্লেন দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন? যদিও এখনো পর্যন্ত এই তথ্য গোটা ভারতবাসীর মনকে তোলপাড় করছে। বেঙ্কটেশ ফিল্মসের প্রযোজনায় সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের ফিল্ম ‘গুমনামী’ যা দেখলেই মানুষের লোমকে খারা করবেই। যদিও আমাকেও করেছিল। ফিল্মটির কাহিনি এবং সংলাপ রচনা সৃজিতের। নেতাজির মৃত্যু বা অন্তর্ধান নিয়ে যে রহস্য পুঞ্জীভূত হয়েছিল,তার সমাধানে বিভিন্ন সময়েগঠন করা হয়েছিল তিনটি কমিশনে, ১/ শাহনওয়াজ(১৯৫৬), ২/ খোসলা (১৯৭০) এবং ৩/মুখার্জি(১৯৯৯)। এই তিনটি কমিশনের তথ্য এই ফিল্মটিতে ঘুরেফিরে এসেছে একাধিকবার। সিনেমাটির শুরুতেই দেখা গেল,নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু দেখা করতে এসেছেন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে। সেখানে উপস্থিত রয়েছেন জহরলাল নেহেরু। স্বাধীনতা তখন প্রায় আসছে বলা চলে। গান্ধীজি অহিংস নীতিতেই স্থির থাকতে চান। কিন্তু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু মনে করেন সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া স্বাধীনতা সম্ভব নয়। তাই তিনি সেখান থেকে বিদায় নিতে চান।
প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো,নেতাজির রহস্যজনক মৃত্যু নিয়ে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয় সাংবাদিক চন্দ্রচূড় ঘোষকে। আর এইদিকে’গুমনামী’ সিনেমার অন্যতম প্রধান অনুপ্রেরণাই হলো দুই নেতাজী গবেষক অনুজ ধর এবং সাংবাদিক চন্দ্রচূড় ঘোষ। তাদের লেখা একটি বই,‘Conundrum: Subhas Bose’s Life after Death’,সেখানে নেতাজীর বিমান দুর্ঘটনা একটি রহস্যাবৃত মৃত্যুর বিপক্ষেই যুক্তি খাড়া করা হবে তা বলাই যায়। কিন্তু হলোও তাই। অনুজ এবং চন্দ্রচূড়ের ১৫ বছরের গবেষণালব্ধ বইয়ের দাবি,১৯৪৫ সালের ১৮ অগাস্ট তাইপেই-এর (তৎকালীন ফরমোসা) তাইহোকু বিমানবন্দরের কাছে বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান নি সুভাষচন্দ্র বোস। শুধু তাই নয়, সেদিন আদৌ কোনও বিমান ওড়েই নি, এবং নেতাজীরই নির্দেশে অতি সযত্নে বিমান দুর্ঘটনার কাহিনী সাজিয়েছিলেন জাপানি সেনাবাহিনীর শীর্ষ আধিকারিকরা। বাস্তবে নেতাজী মাঞ্চুরিয়া হয়ে প্রবেশ করেছিলেন রাশিয়ায়, সেখান থেকে শেষমেশ নেপাল হয়ে ফের পা রেখেছিলেন ভারতের মাটিতে।
নেতাজীর মৃত্যুর রহস্যের জট নিয়ে সাংবাদিক চন্দ্রচূড়ের যুক্তি প্রাধান্য পায় আগাগোড়াই, যদিও ছবির গোড়াতেই স্পষ্ট করে দেওয়া হয় যে এই রহস্যের তিনটি সম্ভাব্য সমাধান রয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য,স্বাধীনতার পর নেতাজীর তথাকথিত অন্তর্ধানের বিষয়টি নিয়ে ভারত সরকার সর্বমোট তিনটি কমিশন গঠন করেছে। ১৯৫৬ সালে গঠিত হয় শাহনওয়াজ কমিটি, যার নেতৃত্বে ছিলেন নেতাজীর এককালের সহযোদ্ধা তথা তৎকালীন সাংসদ শাহনওয়াজ খান। এই কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল,বিমান দুর্ঘটনাতেই মৃত্যু হয় সুভাষচন্দ্রের। কিন্তু সুভাষ বোস বেঁচে আছেন, এই গুজবের জেরে ১৯৭০ সালে ফের কমিশন গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার, নেতৃত্বে পঞ্জাব হাইকোর্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি জি ডি খোসলা। যিনি চন্দ্রচূড়ের মতে পক্ষপাতদুষ্ট, কারণ তিনি দীর্ঘদিনের “নেতাজী বিরোধী”। এই কমিশনও বিমান দুর্ঘটনার তত্ত্বকেই সমর্থন করে।
এর পরেও ১৯৯৯ সালে ফের সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মনোজকুমার মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তৃতীয় একটি কমিশন গঠন করে ভারত সরকার। এই কমিশনের সামনে তথ্য পেশ করতে উপস্থিত হন সাংবাদিক চন্দ্রচূড় এবং তাঁর ‘মিশন নেতাজী’ সংগঠনের সদস্যরা, যাঁদের মধ্যে ছিলেন অনুজও। দীর্ঘ ছ’বছর তদন্তের পর ২০০৫ সালের ৮ নভেম্বর রিপোর্ট জমা দেয় মুখোপাধ্যায় কমিশন। এই রিপোর্টে বলা হয়, নেতাজী যে বিমান দুর্ঘটনাতেই নিহত হন, এ বিষয়ে সেইরকম প্রমাণ নেই। তবে তিনি যে ফৈজাবাদের গুমনামি বাবার ছদ্মবেশে ভারতে তাঁর বাকি জীবনের অধিকাংশ কাটান।সেই দাবির স্বপক্ষেও নিঃসন্দেহ হওয়া যায় না। অর্থাৎ, ধোঁয়াশাতো আমার কাটল না।
এই রিপোর্ট ২০০৬ সালের ১৭ মে সংসদে পেশ করা হয়, কিন্তু তৎকালীন সরকার তা খারিজ করে দেয়। ফলে সরকারিভাবে এখনও বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর তত্ত্বই প্রতিষ্ঠিত। এই তত্ত্বেরই বিপরীতে হাঁটে অনুজ এবং চন্দ্রচূড়ের বই, এবং প্রকারান্তরে সৃজিতের ছবি, যেখানে আমরা দেখি, একটি অ্যাসাইনমেন্টের দৌলতে নেতাজীর অন্তর্ধান রহস্য কীভাবে আগাগোড়া ওলটপালট করে দেয় সাংবাদিক চন্দ্রচূড়ের জীবন এবং জীবনযাপন। কীভাবে পুড়িয়ে দেয় নেতাজিকে নিয়ে গবেষণা করা বইগুলি।
তাহলে আমার কতগুলো প্রশ্ন থাকছে
১/ওই যে ফৈজাবাদে দেখা ভগবানজি তাহলে কে?
২/নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু কি সত্যিই রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন?
৩/ তাহলে কি তাঁর মৃত্যু সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সবই একটা কূটনৈতিক চাল?
৪/ উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় দেখা সেই সন্ন্যাসী যাঁর গলার স্বর হুবহু নেতাজির মতো। পর্দার আড়াল থেকে তিনি কথা বলেন তাঁর প্রিয় মানুষজনদের সঙ্গে। তাঁরা শিহরিত হয় কারণ নেতাজির সঙ্গে কথাবার্তার সময় তাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা উঠে আসে সেই আলাপচারিতায়। তাহলে কি ইনিই সুভাষ? প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে ?????????????
এরপর আসি সাংবাদিক চন্দ্রচূড় বাবুর কথায়
তিনি নেতাজির রহস্যাবৃত মৃত্যুর নিয়ে চরম উঠে পড়ে লেগেছিলেন। খালি নেতাজি আর নেতাজি। এই নিয়ে ওনার স্ত্রী ও খুব বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিলেন। ফলে একদিন তো ওদের দুজনের মধ্যে ডিভোর্স হয়েই গেল। কিন্তু সম্পর্ক থেকে গেলো অটুট। আপ্রাণ পা চালায় চন্দ্রচূড় এক মহৎ দুর্দমনীয় জীবনের ঘনীভূত রহস্যের অন্দরে। রাস্তার ধারে একটি চশমার দোকানে চন্দ্রচূড় কিনলেন নেতাজির মতো চশমা,সেই চশমা চোখে লাগিয়েই রয়লেন। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান নেতাজির অন্তর্ধান।
সিনেমাটি সত্যিই অতুলনীয়। আমার আর বলার মতো ভাষা আসছে না। একবার শুধু বলবো, আপনার নিকটবর্তী সিনেমা হলে গিয়ে দেখে আসুন ‘গুমনামি’ সিনেমা।