বাংলাহান্ট ডেস্কঃ আজ মনসা পূজা (Manasa Puja), মা মনসা (Ma Manasa) মানব সমাজের প্রবাহমানতার প্রতীক, প্রজনন এবং ঐশ্বর্যলাভের পাশাপাশি সর্পদংশনের বিপদ মুক্তার্থে পূজা করা হয় মা মনসাকে। ধারণা করা হয়, মা মনসা ঋষি কাশ্যপ এবং নাগ জননীর কন্যা।
মূলত ঘট স্থাপনের মাধামে যা গর্ভবতী নারীর প্রতীক বা মূর্তির মাধ্যমে মানসা পূজা সম্পন্ন করা হয়। উত্তর এবং উত্তরপূর্ব ভারত ছাড়াও পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে সকল রীতি নীতি মেনে মা মনসার পূজা করা হয়। তবে বলা বাহুল্য যে বাংলাতেই এই পূজা আধিক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। পূজা উপলক্ষে সারা রাত ধরে গায়ক দোয়ারপিসহ পালা আকারে সয়লা গান গাওয়া হয়।
বাংলায় হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে শ্রাবণ মাসে এই উৎসব পালিত হয়। এই দিনটিতে গৃহিণীরা উপবাস করে ব্রত পালনের পাশাপাশি সাপের গর্তে দুধ প্রদান করে থাকেন।
মঙ্গল কাব্যানুযায়ী, নাগ রাজ বাসুকীর মাতা যে বালিকার মূর্তিটি নির্মাণ করেছিলেন, সেই মূর্তিতে মহাদেবের বীর্য নিক্ষিপ্ত হওয়ায় ভূমিষ্ট হয়েছিলেন মা পদ্মাবতী। রাজা পৃথু গাভী রূপে পৃথিবীকে দোহনকালে উৎপন্ন বিষের কর্তৃত্ব নাগরাজ বাসকী মা পদ্মাবতীকে দান করেন।
পরবর্তীকালে মহাদেব মা মনসার প্রতি আকৃষ্ট হলে তিনি তখন জানতে পারেন মনসা তাঁর কন্যা। মহাদেব তাঁর কন্যাকে নিয়ে নিজগৃহে ফিরলে মা চন্ডী মা মনসাকে মহাদেবের জারজ সন্তান মনে করে ভর্তসনা সহ তিরস্কার করেন। অবশেষে ক্রোধের বশবর্তী হয়ে তিনি মনসার একটি চক্ষু দগ্ধ করে দেন। এই কারণেই মা মনসা এক চক্ষু দেবীরূপে পূজিত হন। পরে যদিও সমুদ্র মন্থনের সময় মহাদেব দ্বারা গৃহীত হলাহলকে মা মনসা ধারণ করে তাঁর প্রাণরক্ষা করেন, সেই কারণেই মা মনসা বিষহরা নামেও পরিচিত।
এরপর ঋষি জরতকারু ও মনসার বিবাহ সম্পন্ন হয়। কিন্তু তাঁদের ফুল শয্যার রাতে দেবী চন্ডী ষড়যন্ত্র করে তাঁদের ফুল শয্যা রাতে মা মনসাকে একটি সর্পালঙ্কার পরিধানের পরামর্শ দেন। তারপর তিনি নিজেই সেই রাতে ঘরটিতে একটি ব্যাঙ ছেড়ে দেন। ফলস্বরূপ মা মনসা এবং সর্পবাহিনী ঘরময় ছোটাছুটি করতে শুরু করায়, ঋষি জরতকারু ভয় পেয়ে ঘর ছেড়ে পলায়ন করেন। যদিও তিনি কিছুদিন পর ফিরে আসেন এবং জন্ম হয় তাঁদের সন্তান আস্তিকের।
পরবর্তীকালে নেতোর পরামর্শ অনুসারে মানব ভক্ত সংগ্রহের উদ্দ্যেশ্যে মা মনসা মর্তলোকে অবতরণ করেন। সেখানে প্রথমে অবহেলিত হলেও তিনি নানান উপায়ে মর্তবাসীর পূজা গ্রহণ করেন। মুসলিম শাসক হাসান সহ নানান জাতি মা মনসার পূজা করলেও, চাঁদ সদাগর তাঁর পূজা করতে অস্বীকার করেন। কিন্তু দেবীর স্বীকৃতি পাবার জন্য চাঁদ সদাগরের মনসা পূজা মা পদ্মাবতীর কাছে ছিল অন্তিম শর্ত।
ফলত তা পূরণের জন্য মা মনসা নানান ছলের সাহায্যে সমুদ্রে চাঁদ সদাগরের ছয়টি পুত্রসহ বাণিজ্য জাহাজ ডুবি ঘটান। পাশাপাশি ষড়যন্ত্র করে ইন্দ্রের রাজসভার নর্তক নর্তকী অনিরুদ্ধ এবং ঊষাকে পূর্জন্মের মাধ্যমে চাঁদ সদাগরের সপ্তম সন্তান এবং পুত্রবধূ করে তোলানে। তাঁদের নাম হয় লখিন্দর এবং বেহুলা।
ফুলশয্যার রাতে লখিন্দরকে ছল করে হত্যা করেন মা মনসা। এই কারণেই পতিব্রতা স্ত্রী বেহুলা, তাঁর স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে আনতে উদ্যত হন। ভেলা নিয়ে ভেসে চলেন স্বর্গের উদ্দ্যেশ্যে। পথে নানান কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও, সে স্বর্গ রাজ্যে উপস্থিত হয়ে একটি শর্তের বিনিময়ে স্বামীর প্রাণ ফেরাতে সক্ষম হয়।
পরে মর্তলোকে ফিরে এসে সেই শর্তানুযায়ী চাঁদ সদাগরকে মা মনসার পূজার জন্য অনুরোধ করেন। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা থাকা শর্তেও মহাদেবের পরম ভক্ত চাঁদ সদাগর দক্ষিণ হস্তের বদলে বাম হস্তে মা মনসার পূজা করেন। খুশি হয়ে মা মনসা চাঁদ সদাগরের ছয় সন্তান সহ সমস্ত বাণিজ্য জাহাজ ফিরিয়ে দেন। ফলে মা মনসা দেবীর স্বীকৃতি পান এবং মর্তলোকে তাঁর পূজার প্রলচন ঘটে।