বাংলা হান্ট ডেস্ক : আমরা যদি বলি একটা সময় মহাকাশ গবেষণায় ভারতের (India) চেয়ে অনেকটাই এগিয়ে ছিল পাকিস্তান (Pakistan), তাহলে কি অস্বীকার করবেন? হয়ত শুনতে অবাক লাগবে তবে বাস্তব এটাই যে ইসরো (Indian Space Research Organisation) তৈরি হওয়ার নয় বছর আগেই তৈরি হয়েছিল পাকিস্তানের ‘দ্য স্পেস অ্যান্ড আপার অ্যাটমোসফিয়ার রিসার্চ কমিশন’ (Pakistan Space and Upper Atmosphere Research Commission) ওরফে ‘সুপারকো’ (SUPARCO)। যার নাম অনেকে শুনে থাকলেও অধিকাংশই মনে রাখেনি। অবশ্য ভুলে যাওয়াও খুব একটা অস্বাভাবিক নয় যদিও। কারণ বিগত কয়েক দশকে মনে দাগ কেটে যায় এমন কোনও কাজই করেনি এই পাক এজেন্সি। অথচ একটা সময় এই ‘সুপারকো’কে দেখেই আমেরিকার মনে হয়েছিল, এ হয়ত তাদের তুরুপের তাস হতে পারে। তবে সময়ের ফেরে ইসরোর চেয়ে নয় বছরের বড় এই সংস্থার নাম আজ বিশ্বের সেরা এজেন্সিদের তালিকায় আতশ কাঁচ নিয়ে খুঁজলেও মিলবেনা। কিন্তু কেন এমন অধঃপতন? কী এর ইতিহাস?
বিশ শতকের ষাটের দশকের গোড়ার দিকে দুনিয়ার সমস্ত দেশ যখন সদ্য সদ্য বিজ্ঞানকে বুঝতে শিখেছে তখন মহাকাশের খুঁটিনাটি জানতে মরিয়া আমেরিকা ও সোভিয়েত রাশিয়া। বিশ্ব দরবারে একচেটিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মত্ত ওয়াশিংটন এবং মস্কো। প্রতিযোগিতা যখন তুঙ্গে রাশিয়া তখন মহাকাশে পাঠিয়ে ফেলেছে তাদের প্রথম সফল কৃত্রিম উপগ্রহ এবং প্রথম মহাকাশচারী। রাশিয়া আমেরিকাকে টক্কর দিচ্ছে, তা সহ্য হলনা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন কেনেডির। তড়িঘড়ি ঘোষণা করলেন, চাঁদের মাটিতে তারাই প্রথম মানুষ পাঠাবেন।
আর ঠিক এই আবহেই দেশের মুখ্য বৈজ্ঞানিক পরামর্শদাতা আব্দুস সালামকে নিয়ে আমেরিকায় পৌঁছালেন তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট আয়ুব খান। বিজ্ঞানীমহলে সালামের পরিচিতি তখন কোনও সুপারস্টারের চেয়ে কম নয়। সুযোগ পেয়ে নাসা তাকে আমন্ত্রণ জানায়। আর এই ঝটিকা সফরে এক অবিশ্বাস্য প্রস্তাব যায় পাকিস্তানের কাছে। রকেট উৎক্ষেপণের প্রস্তাব পায় আমাদের পড়শী দেশটি। এমনকি পাক সরকারের ভাঁড়ারে যথেচ্ছ টাকাপয়সা না থাকায় সেসময় আমেরিকা নিজেই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানের দিকে। আমেরিকার তত্ত্বাবধানে সুপারকো শুরু করে দেয় মহাকাশ অভিযানের তোড়জোড়।
আরও পড়ুন : ‘চন্দ্রযান ৩’র পর মিশন ‘ব্ল্যাকহোল’! ইসরোর নয়া অভিযানের রূপকার এই বাঙালি বিজ্ঞানী, চেনেন তাঁকে?
এরপর মাত্র ন’মাসের মধ্যে সফলতার শীর্ষে পৌঁছায় সুপারকো। পাকিস্তানের তৈরি রকেট পৌঁছে যায় মহাকাশে। যদিও এই একই প্রস্তাব তখন ভারতের কাছেও এসেছিল। তবে টাকার অভাবে আমাদের দেশ তা করে দেখাতে না পারলেও মার্কিন সহায়তায় অসাধ্যসাধন করে দেখিয়েছিল পাকিস্তান। রকেট উৎক্ষেপণে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং গোটা এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় স্থানে নাম লিখিয়েছিল পাকিস্তান। এখানেই শেষ নয়, তারপর একটা লম্বা সময় পর্যন্ত একাধিক পরীক্ষা নিরিক্ষা করেছে পাক এজেন্সি সুপারকো। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান তৈরি করে তাদের প্রথম রকেট নির্মাণ প্ল্যান্ট। পরবর্তী দুই বছরে আরও দুটি পাক রকেট পাড়ি দেয় মহাকাশে। তবে পতন শুরু হয় আশির দশকের পর থেকে।
আরও পড়ুন : নতুন বছরে চরম হয়রানি সুন্দরবনে, আটক ১ হাজারের বেশি মানুষ
এরপর পাকিস্তান জোট বাঁধে চিনের সাথে। বেশ কয়েকটি কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠালেও তাতে বিশেষ কিছু লাভ হয়নি। এরপর দিনদিন পতনের দিকেই এগিয়ে গেছে পাকিস্তানের ‘সুপারকো’। এককালীন সেরা ‘সুপারকো’র কেন এই অধঃপতন? উত্তর খুঁজতে গিয়ে সামনে আসে বেশ কয়েকটি কারণ। তার একটি অন্যতম প্রধান কারণ হল ‘পর্যাপ্ত অর্থ’ এবং ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’। পাকিস্তানের বাজেটে অন্যান্য খাতে যথেষ্ঠ টাকা ঢালা হলেও গবেষণার দিকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ করা হয়নি। সেই সাথে কিছু মানুষ দায়ি করে থাকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে। গবেষণা ক্ষেত্র এবং প্রশাসনিক বিষয়কে সবসময় আলাদা করে রাখার কথাই বলেছে বিশেষজ্ঞরা। যদিও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পাক সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিকদের মাঝে মাঝেই সুপারকোর কোনও না কোনও গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছে। আদৌ তারা সেই পদের জন্য যোগ্য কিনা তা যাচাই না করেই দেওয়া হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ দায়ভার।
আরও পড়ুন : আটকে রেলের বহু প্রকল্প! সায় নেয় রাজ্যের, মমতাকে নিশানা বৈষ্ণবের
এছাড়াও গবেষণার কাজে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের কারণেও পিছিয়ে পড়েছে পাকিস্তান। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে ভারতের কাছে লজ্জাজনক হার এবং ১৯৭৪ সালে ভারত পরমাণু বোমা তৈরিতে সফল হওয়ার পর থেকেই পাকিস্তান নিজেদের উন্নত করার চেয়ে ভারতকে শেষ করার চেষ্টায় মগ্ন হয়। মহাকাশ গবেষণার হয়েছিল বটে তবে তা নিজেদের লাভের চেষ্টা করে নয়, বরং কীভাবে ভারতের ক্ষতি করা যায় সেই চেষ্টায়। সেই সময় মহাকাশকে ব্যবহার করে সামরিক সাফল্যের দিকে নজর ঘুরিয়েছিল পাকিস্তান। ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে মন দেয় ইসলামাবাদ। নব্বইয়ের দশকে পাকিস্তান তাতে সফল হয়ে গেলেও নানাদিক থেকে বাধা আসতে থাকে। নানা কারণে FATF এর কাছে গ্রে লিস্টে পড়ে যায় পাকিস্তানের নাম। যে কারণে বিদেশি সাহায্যও বন্ধ হয়ে যায়। তারপর থেকেই মহাকাশে পাকিস্তানের স্বপ্নের উড়ান মুখ থুবড়ে পড়ে।