বাংলা হান্ট ডেস্ক: একদিকে আমাদের দেশ যখন প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত হচ্ছে ঠিক সেই সময় এখনও দেশের কিছু স্তরের মানুষ কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে, দেশেরই কিছু ভবিষ্যৎদ্রষ্টার জন্য সহজ হয়ে যায় তাঁদের কাজ।
কায়িক শ্রম এবং আধুনিক প্রযুক্তির অসাধারণ মেলবন্ধন ঘটিয়ে আজ চূড়ান্ত সফলতার শীর্ষে রয়েছে “সম্মান ফাউন্ডেশন”। আর এই ফাউন্ডেশনের যিনি প্রতিষ্ঠাতা সেই ইরফান আলমকে নিয়েই এই প্রতিবেদন।
আহমেদাবাদের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজম্যান্টের (IIM) প্রাক্তন ছাত্র ইরফান প্রথম থেকেই দরিদ্রদের প্রতি সংবেদনশীল ছিলেন। আর তাঁর এই গুণটি তাঁকে জীবিকার জন্য এমন একটি ব্যবসা খুঁজে বের করতে অনুপ্রাণিত করেছিল যেটায় নিয়মিত আয় হয়।
এমনিতেই ভারতের শহরাঞ্চলে নিয়মিত যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে প্রায় ৩০ শতাংশ ব্যবহার হয় রিকশার। তাই তিনি রিকশাচালকদের কর্মসংস্থানের জন্য একটি সংস্থা গঠনের পরিকল্পনা করেন।
ইরফান, বৈদেশিক বাণিজ্যে স্নাতকোত্তর এবং অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি “নেভার সে নেভার” নীতিতে বিশ্বাসী। বিহারের বেগুসরাইতে জন্মগ্রহণকারী ইরফান ২০০৭ সালে রাজধানী শহর পাটনা থেকে ৩০০ জন রিকশাচালককে নিয়ে একটি ব্যবসা শুরু করেছিলেন।
ওই রিকশাগুলিতে সঙ্গীত, পত্রিকা, সংবাদপত্র, প্রাথমিক চিকিৎসা সামগ্রী, জলখাবার এবং বিজ্ঞাপন সবকিছুর ব্যবস্থা ছিল। সমগ্র ব্যবস্থাটি যাত্রীদের কাছে আরামদায়ক এবং উপভোগ্য হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, রিকশাচালকদেরও যাত্রী পেতে সুবিধা হয়।
ইরফানের এই ব্যবসায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দারুণভাবে সফলতা পায়। তিনি তাঁর আধুনিক নকশা দিয়ে রিকশাচালকদের উপকৃত করেছেন। পাশাপাশি, ভারতে প্রথম প্রি-পেইড রিকশা চালু হয়ে তাঁর উদ্যোগেই।
তাঁর ওই অভিনব ব্যবসার কথা মাথায় আসে যখন তিনি একদিন গ্রীষ্মকালে রিকশায় করে কোথাও একটা যাচ্ছিলেন। সেই সময় তৃষ্ণার্ত হওয়ার কারণে তিনি যখন রিকশাচালকের কাছে জল চেয়েছিলেন এবং জল না থাকায় চালক সেটি দিতে পারেননি তখনই তিনি উপলব্ধি করেন যে রিকশায় যদি জল ও কিছু খাবারের জিনিস থাকে তাহলে যাত্রীদের সুবিধে হবে এবং চালকদেরও বাড়তি আয় হবে।
ইতিমধ্যেই ইরফানের এই প্রচেষ্টা বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। প্রথমে এটি শুরু করতে তাঁরা কোথাও কোনো সহায়তা না পাওয়ায় পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক থেকে লোন নিয়ে তিন ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে মিলে রিকশার ডিজাইন করেন তিনি।
ছোট পরিসরে শুরু হওয়া এই উদ্যোগে, বর্তমানে সারাদেশের ৫ লক্ষেরও বেশি রিকশাচালক ইরফানের সংগঠন “সম্মান ফাউন্ডেশন”-এর সাথে যুক্ত রয়েছেন। ২০১০ সালে, তাঁর এই অর্জন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার নজরেও পড়ে। ওই বছরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে তরুণ উদ্যোক্তাদের শীর্ষ সম্মেলনে যোগদানের জন্য নির্বাচিত কয়েকজনের মধ্যে ইরফান ছিলেন।
যদিও, সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে এগোলেও ইরফানও বিতর্কের কারণে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে আসেন। তাঁর বিরুদ্ধে নবেন্দু নামের এক ওয়েবসাইট নির্মাতাকে অপহরণের অভিযোগ ওঠে। জানা গিয়েছিল যে, ওয়েবসাইট তৈরির জন্য ইরফানের কাছ থেকে অগ্রিম অর্থ গ্রহণ করেছিলেন নবেন্দু। পাশাপাশি, ওয়েবসাইট নিয়ে নবেন্দুর সঙ্গে ইরফানের কিছু বিবাদও ছিল।
এরপরই অপহৃতের বাবা শাস্ত্রীনগর থানার এএসপিকে নিয়ে ইরফানের অফিসে পৌঁছন। সেখানে ইরফান এবং তার সহকর্মী গোবিন্দ ঝা, যুবরাজ এবং রোহিত ওরফে রাজকুমারকে ২০১১ সালের ১৩ মে নবেন্দুকে অপহরণের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়।
এরপরই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের হস্তক্ষেপে ১৪ মে তিনি থানা থেকে মুক্তি পান। এই ঘটনার পর ইরফানের উপর রাজ্য ছাড়ার জন্য ক্রমাগত চাপ ছিল, কিন্তু ইরফান দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন যে, তিনি অপরাধীকে খুঁজে বের করবেন।
এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের জায়গা ধরে রেখেছেন ইরফান। তিনি আজ পর্যন্ত বহু পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ইরফান বিজনেস ওয়ার্ল্ডের “এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যাওয়ার্ড” পেয়েছেন। ইন্ডিয়া টুডে কর্তৃক ভারতের ইয়ুথ আইকনের তালিকাতেও তিনি নির্বাচিত হয়েছেন। পাশাপাশি, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ভারতের সেরা ৩০ টি যুবকের মধ্যেও তিনি নির্বাচিত হন।
এছাড়াও ইরফান গার্ডিয়ান ম্যাগাজিন, লন্ডন এবং দ্য ইকোনমিস্ট-এও স্থান পেয়েছেন। টাটা ন্যেনের “হটেস্ট স্টার্টআপ অ্যাওয়ার্ড”-এর মূল পর্বে তিনি ছিলেন এবং বিশ্বব্যাঙ্কের উদ্ভাবনী পুরস্কারের বিজয়ীও হয়েছেন তিনি। ইরফানের এই প্রজেক্টটি বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও শেয়ার করা হয়েছে।
অতএব ইরফানের সাফল্যের কাহিনি শুনে এটা প্রমাণিত যে, দ্বন্দ্বের মধ্যেও ইরফান তাঁর কাজে সাফল্য নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছেন। স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান থেকে পড়াশোনা শেষ করে গরীবদের সেবার পথ বেছে নেন ইরফান আলম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পরিস্থিতি ইরফানের মনোবল ভাঙতে চাইলেও তাঁর মনোবল এতটুকুও ভাঙেনি!