ভারতকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে তা পূরণ করেন সারাভাই! এই কাহিনি চমকে দেবে সবাইকে

বাংলা হান্ট ডেস্ক: ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর বিশ্বজুড়ে মহাকাশ আধিপত্য বিস্তারের লড়াই শুরু হয়। আমেরিকা-রাশিয়ার মতো উন্নত দেশগুলি কার্যত দিনরাত এক করে এই কাজ করতে থাকে। অন্যদিকে, ভারতের মতো উদীয়মান দেশগুলি তখনও পর্যন্ত এই ভাবনা ভাবতেও পারেনি। কিন্তু, ভারতের একজন ব্যক্তি সেইসময় তাঁর দেশকে মহাকাশে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। শুধু তাই নয়, সেই মানুষটি তাঁর সারা জীবন উৎসর্গও করেছিলেন বিজ্ঞান ও ভারতের স্বার্থে। আর তিনি হলেন মহান বিজ্ঞানী বিক্রম অম্বালাল সারাভাই।

পারিবারিক ব্যবসা ছেড়ে বিজ্ঞানসাধনায় যোগ দেন:
১৯১৯ সালের ১২ আগস্ট বিক্রম সারাভাই, গুজরাটের আহমেদাবাদে একটি ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। এমতাবস্থায়, বিক্রম চাইলেই তিনি সারাটা জীবন পারিবারিক ব্যবসায় যুক্ত হয়ে ভালোভাবে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু, তিনি কখনোই বিলাসবহুল জীবন চাননি। বরং, তাঁর লক্ষ্য ছিল সম্পূর্ণ আলাদা।

ছোটবেলা থেকেই বিক্রম সারাভাইয়ের বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রবল কৌতূহল ছিল। বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ থাকায় তিনি স্কুল শেষ করার সাথে সাথেই কলেজে পড়ার জন্য কেমব্রিজ চলে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বিক্রম ভারতে ফিরে আসেন। যদিও, দেশে ফেরার পর বিক্রম উপলব্ধি করেন যে, বিজ্ঞানের অগ্রগতির ক্ষেত্রে ভারত বিদেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে রয়েছে। আর এর প্রধান কারণ হল ভারতে তখন ভালো প্রতিষ্ঠানের অভাব ছিল। এমতাবস্থায়, তিনি ১৯৪৭ সালে আহমেদাবাদে “দ্য ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি” তৈরি করেন এবং দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে কাজ শুরু করেন।

দেশে একাধিক ইনস্টিটিউট এবং পারমাণবিক কেন্দ্রের পথচলা শুরু হয়:
দ্য ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি তৈরি করার পর, বিক্রম সারাভাই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতে তখনও অনেক উন্নত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। তিনি চেয়েছিলেন শুধু বিজ্ঞান নয়, ব্যবসার মতো বিষয়ও অগ্রগতির প্রয়োজন। এই কারণেই তিনি আহমেদাবাদের বিখ্যাত ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ ম্যানেজমেন্ট (আইআইএম) তৈরি করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি আরও একাধিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন। যেগুলি হল:
১. Community Science Centre
২. Darpan Academy for Performing Arts
৩. Vikram Sarabhai Space Centre
৪. Space Applications Centre
৫. Electronics Corporation of India Limited
৬. Uranium Corporation of India Limited

এই প্রতিষ্ঠানগুলি থেকে বিক্রম সারাভাইয়ের একটাই আশা ছিল যে এগুলি ভারতকে অন্যান্য দেশের মতো বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে আরও উন্নত করবে। এদিকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরমাণু শক্তি একটি প্রধান প্রয়োজন হয়ে ওঠে। ওই সময় প্রতিটি দেশ চাইছিল যাতে তাদের কাছে নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট থাকে। আমাদের দেশেও তখন হোমি ভাবা এই বিষয়ে কাজ করছিলেন। মূলত, তিনি ভারতকে পরমাণু শক্তিধর দেশে পরিণত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

ওই সময়, বিক্রম সারাভাই হোমি ভাবার কৃতিত্বে খুব মুগ্ধ হন। এদিকে, ১৯৬৬ সালে হোমি ভাবার মৃত্যুর পর, তাঁর জায়গায় বিক্রম সারাভাইকে ভারতের পরমাণু শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়। হোমি ভাবার কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বিক্রম সারাভাই ভারতেই পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণ শুরু করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল এই পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে ভারতের প্রতিটি কোণ আলোকিত হবে। শুধু তাই নয়, বিক্রম সারাভাই এই পারমাণবিক শক্তিকে সামরিক কাজেও ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।

ISRO তৈরির মাধ্যমে শুরু হল মহাকাশ যাত্রার স্বপ্ন:
বিক্রম সারাভাই প্রথম থেকেই মহাকাশ নিয়ে খুব আগ্রহী ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন পশ্চিমী দেশগুলির মতো ভারতও এই দিকে কাজ করুক। প্রাথমিকভাবে, তিনি এই কাজটি করার জন্য সরকারকে রাজি করার চেষ্টা করলেও ১৯৫৭ সালে যখন রাশিয়া তার রকেট মহাকাশে পাঠায়, তখন সারাভাই সরকারকে এর গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন।

এরপর ১৯৬২ সালে, তিনি মহাকাশ গবেষণার জন্য Indian National Committee for Space Research গঠন করেন যা পরবর্তীতে ISRO নামে পরিচিত হয়। পাশাপাশি, ত্রিবান্দ্রমপুরমের থাম্বাকে প্রথম রকেট উৎক্ষেপণ স্টেশন তৈরির জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল। হোমি ভাবাও এই কাজে বিক্রম সারাভাইকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। এর এক বছরের মধ্যেই, লঞ্চিং স্টেশনটি সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত হয়ে যায় এবং ১৯৬৩ সালের ২১ নভেম্বর সেখান থেকে প্রথম প্রাথমিক উৎক্ষেপণ করা হয়।

এমতাবস্থায়, ১৯৬৬ সালে, বিক্রম সারাভাই এবং নাসার মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, যার অধীনে নাসা ভারতীয় লঞ্চিং স্টেশন থেকে মহাকাশে একটি উপগ্রহ পাঠাবে বলে স্থির হয়। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে, নাসা SITE নামে একটি উপগ্রহ মহাকাশে পাঠায়। তবে সারাভাই তা দেখে যেতে পারেনি। কারণ, ১৯৭১ সালেই তিনি পাড়ি দিয়েছিলেন না ফেরার দেশে। মূলত, তিনিই ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট প্রকল্পে কাজ করছিলেন। যদিও, তিনি তা পূরণ করতে পারেননি।

vikram

তবে তাঁর প্রয়াণের পর বাকি সদস্যরা তাঁর এই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করেছেন। পাশাপাশি, বিক্রম সারাভাইয়ের দেখানো পথ অনুসরণ করে, ১৯৭৫ সালে, ভারত সফলভাবে তার প্রথম উপগ্রহ “আর্যভট্ট” মহাকাশে প্রেরণ করেছিল। এমতাবস্থায়, আমাদের দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতি তথা মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে বিক্রম সারাভাইয়ের অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

Sayak Panda
Sayak Panda

সায়ক পন্ডা, মেদিনীপুর কলেজ (অটোনমাস) থেকে মাস কমিউনিকেশন এবং সাংবাদিকতার পোস্ট গ্র্যাজুয়েট কোর্স করার পর শুরু নিয়মিত লেখালেখি। ২ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাংলা হান্ট-এর কনটেন্ট রাইটার হিসেবে নিযুক্ত।

সম্পর্কিত খবর