আজ দেশের সেই বীর শহীদের জন্ম জয়ন্তী, যাকে সর্বপ্রথম সেনার সর্বোচ্চ সন্মান দেওয়া হয়েছিল। ১৯৫০ সালে প্রথমবার দেশের সর্বোচ্চ সৈন্য সন্মান পরমবীর চক্র (Param Vir Chakra) দেওয়া শুরু হয়েছিল। ভারতীয় সেনা এই সবথেকে বড় সন্মানের জন্য মেজর সোমনাথ শর্মাকে (Major Somnath Sharma) বেছে নিয়েছিল।
২১ জুন ১৯৫০ মেজর সোমনাথ শর্মাকে পরমবীর চক্রে সন্মানিত করা হয়েছিল। দেশের এই বীর জওয়ানের বীরত্বের কথা শুনলে আপনার শরীরের লোম খাড়া হয়ে যাবে। ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ইনি যেই বীরত্বের পরিচয় দিয়েছিল। আর ওনার এই বীরত্বের জন্য গোটা দেশ জুড়ে ওনাকে এখনো মনে রেখেছে।
মেজর সোমনাথ শর্মার জন্ম ৩১ জানুয়ারি ১৯৩১ সালে হিমাচল প্রদেশের কাঙরায় হয়েছিল। সেই সময় কাঙরা পাঞ্জাবের অংশ ছিল। ওনার বাবা অমর নাথ শর্মা একজন মিলিটারি অফিসার ছিলেন। মেজর সোমনাথ শর্মা নৈনিতালের শেরউড কলেজে পড়াশুনা করেছিলেন।
১৯৪২ সালে রয়াল মিলিটারি কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর উনি সেনায় যোগ দেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মিতে থাকার সময় উনি বার্মায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অদম্য সাহস আর বীরত্বের জন্য উনি ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে তিনি অদম্য সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন।
মেজর সোমনাথ শর্মাকে ব্যাটেল অফ বডগামের জন্য যেতে হত। দেশ ভাগের সময় ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ লেগেছিল। অনুপ্রবেশকারীদের আড়ালে পাকিস্তানি সেনা কাশ্মীরে হামলা করে দিয়েছিল। ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে ভারতীয় সেনা কাশ্মীরের সুরক্ষার জন্য নিজেদের জওয়ান মোতায়েন করে।
মেজর সোমনাথ শর্মা সেই সময় কুমাউ ব্যাটেলিয়নের ডি কোম্পানিতে ছিলেন। যখন ওনার ব্যাটেলিয়ানকে কাশ্মীরে যাওয়ার আদেশ দেওয়া হয়, তখন সোমনাথ শর্মার ডান হাতে প্লাস্টার করা ছিল। উনি হকি খেলার সময় চোট পেয়েছিলেন। সেনার অফিসারেরা ওনার হাতের ওই অবস্থা দেখে, ওনাকে এই অপারেশন থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দেয়। কিন্তু মেজর সোমনাথ শর্মা মানলেন না। তিনি যুদ্ধ শুধু নিজের হাত দিয়ে নয়, নিজের সাহসিকতা আর বীরত্ব দিয়ে জিততে চেয়েছিলেন।
এরপর নাছোড়বান্দা সোমনাথকে জওয়ানের সাথে বডগামে পাঠায় সেনা। ৩রা নভেম্বর ১৯৪৭ সালে বডগামে সেনার তিন কোম্পানি মোতায়েন হয়। ওনাকে উত্তরের দিক থেকে পাক সেনাদের শ্রীনগর যাওয়া থেকে আটকানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। আর সেই সময় সেনার উপর স্থানীয়রা ফায়ারিং শুরু করে দেয়। আম জনতার ক্ষতি না হয়, সেই কারণে সেনা পালটা জবাব দেয়নি।
সেই সময় প্রায় ৭০০ পাকিস্তানি জঙ্গি আর সেনা বডগামের দিকে এগোতে থাকে। তাঁরা গুলমার্গ থেকে বডগামের দিকে এগিয়ে জাচ্ছি। মেজর সোমনাথ শর্মার ডি কোম্পানিকে তিন দিক থেকে শত্রুরা ঘিরে নেয়। ওনার কোম্পানির উপর মর্টার দিয়ে হামলা করছিল শত্রুরা। মেজর সোমনাথ শর্মার কোম্পানি বীরের মতো শত্রুদের সাথে মোকাবিলা করে।
একহাতে প্লাস্টার থাকার পরেও মেজর সোমনাথ তিনদিক থেকে হওয়া হামলা সামলাচ্ছিলেন। উনি একসাথে ভারতীয় সেনার তিনটি পোস্ট সামলাচ্ছিলেন। হামলার সময় উনি বারবার এক পোস্ট থেকে আরেক পোস্টে দৌড়াদৌড়ি করছিলেন। শ্রীনগর আর এয়ারপোর্টকে বাঁচানোর জন্য জঙ্গি এবং পাক সেনাদের সেখানে আটকে রাখা জরুরি ছিল। ডি কোম্পানির উপর তিন তরফ থেকে হওয়া হামলায় জবরদস্ত লোকসান হয়েছিল। মেজর সোমনাথ শর্মা নিজে দৌড়ে দৌড়ে নিজেই সেনার মধ্যে হাতিয়ার আর গোলা-বারুদ সাপ্লাই করছিল। একটি লাইট ম্যাশিন গান উনি নিজের হাতেই রেখেছিলেন।
সেই সময় জঙ্গিরা একের পর এক মর্টার শেল ফায়ার করেই চলছিল সেনার উপর। জঙ্গিরা ভারতীয় সেনার হাতিয়ার এবং বিস্ফোটক রাখার জায়গায় হামলা করে দেয়। তখনই বড়সড় একটি বিস্ফোরণ হয়, আর সেই বিস্ফোরণে শহীদ হন সোমনাথ শর্মা। শহীদ হওয়ার আগে মেজর সোমনাথ শর্মা হেডকোয়ার্টারে একটি বার্তা পাঠিয়েছিল। ওই বার্তায় লেখা ছিল, ‘শত্রুরা আমাদের থেকে মাত্র ৫০ ইয়ার্ড দূরে রয়েছে। আমাদের সংখ্যা অনেক কম। আমাদের উপর ভয়ানক হামলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা এক ইঞ্চিও জমি ছারিনি। আমরা আমদের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়ব।”
যতক্ষণ সোমনাথের ইউনিটকে বাঁচানোর জন্য ব্যাটেলিয়ান পৌঁছায়। ততক্ষণ অনেক ক্ষতি হয়ে গেছিল। যুদ্ধের ময়দানে একজন ভারতীয় সেনার বিপরীতে শত্রুর সংখ্যা ৭জন ছিল। এরপরেও মেজর শর্মার ডি কোম্পানি ২০০ জঙ্গি আর পাকিস্তানি সেনাকে খতম করে। তাঁদের আর এগিয়ে যেতে দেয়নি মেজর শর্মার ইউনিট।
এই যুদ্ধে মেজর সোমনাথ শর্মা আর একজন জুনিয়ার অফিসারের সাথে ২০ জন জওয়ান শহীদ হয়ে যান। মেজর শর্মার দেহ তিনদিন পর পাওয়া যায়। ওনার দেহকে ওনার পিস্তল হোল্ডার আর ওনার বুকের মধ্যে থাকা ভাগবত গীতার কারণে চেনা যায়। মেজর সোমনাথ শর্মার বীরত্বের জন্য ভারতীয় সেনার ছাতি গর্বে চওড়া হয়ে যায়। আর এরজন্য দেশের প্রথম পরমবীর চক্র মেজর সোমনাথ শর্মাকে দেওয়া হয়।