বাংলা হান্ট ডেস্কঃ কর্ড লাইনে বর্ধমান থেকে হাওড়া যাবার পথে ‘বেলানগর’ রেলস্টেশনকে তো পিছনে ফেলে গিয়েছেন অনেকবারই। কিন্তু জানেন কি এই ‘বেলানগর’ নামের ইতিহাস? এই নামের পিছনে আসলে রয়েছেন এক বাঙালি কৃতি কন্যা বেলা বসু। বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে রয়েছে বসু পরিবার। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রসঙ্গ উঠলেই সর্বপ্রথম যে বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামী সকলের মন জয় করে নেন তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তবে সুভাষ পরিবারের বাকি সদস্যদের সম্পর্কে এমনভাবে কথা হয় না সব সময়।
জানিয়ে রাখি, বেলা বসু ছিলেন সুভাষ পরিবারেরই অন্যতমা। ১৯৪১ সালে সুভাষচন্দ্রের ইংরেজ বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে পালানোর সময় বড় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন ভাইপো শিশির বসু এবং ভাইঝি ইলা বসু। এই ইলা বসুরই ছোট বোন ছিলেন বেলা। অর্থাৎ তিনি ছিলেন সুভাষ চন্দ্রের সেজ দাদা সুরেশ চন্দ্র বসুর কন্যা। ১৯২০ সালে তার জন্ম হয় উত্তর ২৪ পরগনার কোদালিয়ায়। তবে শুধুমাত্র সুভাষচন্দ্রের ভাইঝি হিসেবে নয়, নিজের অসামান্য কর্মগুণেই সকলের কাছে আজও অমর হয়ে রয়েছেন বেলা। ১৯৩৬ সালে তার বিবাহ হয় যশোরের হরিদাস মিত্রের সঙ্গে। পরবর্তী ক্ষেত্রে আজাদ হিন্দ ফৌজের চিফ অফ ইন্টেলিজেন্স পদেও নিযুক্ত হন হরিদাস। শুরু থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রতী ছিলেন বেলা। বিবাহের পর ১৯৩৮ সালে নিজের শ্বশুরবাড়িতেই একটি মহিলা সমিতি গড়ে তোলেন বেলা। ১৯৪০ সালে যখন রামগড়ের সভা থেকে কংগ্রেসের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বেরিয়ে আসেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং ডাক দেন মুক্ত ভারতের। সেই অপস বিরোধী সম্মেলনে মহিলা সমিতির দায়িত্ব দেওয়া হয় মাত্র ১৯ বছর বয়সী বেলা বসুর কাঁধে। পরবর্তী ক্ষেত্রে, পূর্ব এশিয়া থেকে ভারতে আসা সুভাষ চন্দ্রের আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার কাজ ছিল তার কাঁধে। তাদের দেখাশোনা এবং নিরাপত্তা প্রদানেরও দায়িত্ব নিতেন বেলা। এসময় বহুবার নিরাপদে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীদের আশ্রয়ে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
শুধু তাই নয়, ১৯৪৪ সালে গোপনে সুভাষচন্দ্রকে রেঙ্গুন এবং সিঙ্গাপুরে বার্তা পাঠানোর জন্য গঠন করা হয় ট্রান্সমিশন সার্ভিস। তার কলকাতা কেন্দ্রের দায়িত্বেও ছিলেন এই বেলাদেবী। নিজের বাড়ি থেকে ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রায় আট মাস অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে এই বার্তা পাঠানোর দায়িত্ব পালন করেন তিনি। অবশ্যই সঙ্গী ছিলেন স্বামী হরিদাস মিত্র। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য আজাদ হিন্দ বাহিনীর বেশকিছু সেনাকে অস্ত্রশস্ত্রসহ উড়িষ্যার উপকূলে পাঠিয়েছিলেন নেতাজি। কোনারক মন্দিরের কাছে তাদের সফল অবতরণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন বেলা ও হরিদাস। এর জন্য নিজের সমস্ত গয়নাও বিক্রি করে দিতে হয়েছিল তাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, দেশদ্রোহিতার অপরাধে গ্রেপ্তার হন স্বামী হরিদাস মিত্র। সঙ্গে গ্রেপ্তার হন বিপ্লবী পবিত্র রায়, জ্যোতিষ চন্দ্র বসু এবং অমর সিং গিল। তারপর থেকেই সম্পূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন বেলা।
এই সময় ১৯৪৫ সালে স্বামী হরিদাস সহ বাকি ২১ জন বিপ্লবীর ফাঁসির আদেশ আসে। শোনা যায় সেসময় গান্ধীজীর শরণাপন্ন হয়েছিলেন বেলা। আর গান্ধীজী তাকে পরীক্ষা করতে বলেছিলেন তিনি শুধু হরিদাসের জন্য চেষ্টা করে দেখতে পারেন। কিন্তু তাতে দৃঢ়তার সঙ্গে অসম্মতি প্রকাশ করেন বেলা। তিনি জানান, যদি কিছু করতে হয় তাহলে সকলের জন্য করুন গান্ধীজী। নাহলে প্রয়োজন নেই। কারণ তিনি স্বার্থপর হতে পারবেন না। বেলার এই আদর্শে খুশি হন গান্ধীজী। শেষ পর্যন্ত তার চেষ্টাতেই ফাঁসির আদেশ রদ হয় হরিদাস সহ অন্যান্য বিপ্লবীদের। ফাঁসির দণ্ডকে বদলে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে। ১৯৪৭ সালে নেতাজির ঝাঁসি রেজিমেন্ট অর্থাৎ যার প্রধান ছিলেন লক্ষ্মী সায়গল, তার আদলে কলকাতায় ঝাঁসির রানী সংগঠন তৈরি করেন বেলা। সম্পূর্ণ জড়িত হয়ে পড়েন জনসেবার কাজে। বাংলাদেশেও বেশ কয়েকটি সংগঠন তৈরি করা হয়। স্বামী হরিদাস কংগ্রেসে যোগ দিয়ে সরাসরি সরকারে যোগ দিলেও কখনো নির্বাচনী রাজনীতিতে দেখা যায়নি বেলাদেবীকে। বরং বালি ও ডানকুনির মধ্যবর্তী অভয়নগর অঞ্চলে শরণার্থীদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে প্রাণপাত পরিশ্রম করতে থাকেন তিনি। কিন্তু হাড়ভাঙা পরিশ্রমের জেরে ভাঙতে থাকে শরীর। শেষ পর্যন্ত মাত্র ৩২ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
১৯৫৮ সালে স্মৃতিতে ডানকুনি এবং বালির মধ্যবর্তী এই স্টেশনের নাম বেলানগর রাখা হয়। উদ্বোধন করেন তৎকালীন ভারতীয় রেলের উপমন্ত্রী তথা বেলার অন্যতম সহযোদ্ধা’ আজাদ হিন্দ বাহিনীর শাহনেওয়াজ খান। স্বাধীনতা আন্দোলনে গর্বের সঙ্গে স্মরণ করা হয় সুভাষচন্দ্রের নাম। কিন্তু অভেদ্য পর্দার আড়ালেই থেকে গেলেন বেলা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য রাজ্যের বর্তমান অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এই বেলা বসুরই সুযোগ্য সন্তান।