বাংলাহান্ট ডেস্ক : কথায় বলে, জানার কোন শেষ নেই আর শেখার কোন বয়স নেই। আর একথার সার্থক রূপ যেন ফুটে উঠেছে ঝর্ণা রায়ের জীবনে। ঝর্ণাদেবীর বয়স ৪৫। কিন্তু তাতে কী ? মধ্যবয়সের দোরগোড়ায় এসেও তিনি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার স্বপ্ন দেখছেন।
আসলে, ইচ্ছে থাকলেই যে উপায় হয় তা আরোও একবার নিজের জীবনযুদ্ধের মাধ্যমেই প্রমাণ করে দিতে চান ঝর্ণাদেবী। বিশ্বসংসারে বহু মানুষ রয়েছেন যারা নিজেদের শারীরিক, মানসিক এবং নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতা কে দূরে সরিয়ে রেখে তাদের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেছেন। তাদের মতোই ঝর্ণাদেবীও অসুস্থ স্বামীর পরিচর্যা করে একা হাতে সংসারের কাজ সামলে নিজের পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছেন।
পেশায় তিনি পরিচারিকা, একই সঙ্গে সামলান পঞ্চায়েত প্রধানের দায়িত্বও। ঘাসফুলের টিকিটে লড়াই করে দু’বার ছিনিয়ে নিয়েছেন পূর্ব বর্ধমানের মেমারির বিজুর ২ পঞ্চায়েত প্রধানের পদ। ঝর্নাদেবীর কর্মদক্ষতা ও তার সততার কথা স্বীকার করে নেন তার অতি বড় বিরোধীরাও। এলাকার বিজেপি নেতা বিশ্বজিৎ পোদ্দার বলেন, ‘‘উনি পরিচারিকার কাজ করেন। তবে সে জন্য প্রধানের কাজে প্রভাব পড়ে না।’’ সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশেষ কোনারের কথায়, ‘‘অর্থনৈতিক প্রশ্নে ওই প্রধানের স্বচ্ছতা রয়েছে।’’
খড়ের চাল, অ্যাসবেস্টসের ছাউনির বাড়িতে থেকেও এলাকার মানুষের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখেন ঝর্ণা। দিবারাত্র অক্লান্ত পরিশ্রমের পরেও কিডনি, হৃদরোগের সমস্যায় শয্যাশায়ী স্বামী নীলু রায়ের সেবা যত্ন করেন। পঞ্চায়েতের বিভিন্ন সভায় হাজির থাকা, প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয়সাধন, উন্নয়নমূলক কাজ, সামাজিক প্রকল্প রূপায়ণ করার কাজও দুর্দান্ত দক্ষতায় সামলে দেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, “রাস্তা, নর্দমা গড়া থেকে শুরু করে, এলাকায় সাংস্কৃতিক চর্চার দিকেও প্রধানের নজর রয়েছে। জাবুই-মেল্লা গ্রামে নাট্যমঞ্চ তৈরি করে দিয়েছেন উনি। পানীয় জলের ব্যবস্থাও করছেন।’’
প্রধান হয়েও লোকের বাড়ি কাজ করায়, ঝর্ণাকে নানান মহল থেকে শুনতে হয় নানান কথা। তিনি অবশ্য পরিস্কার বলেন, ‘‘প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। লোকের কথায়, আমার পেট ভরবে না, ওষুধের টাকাও আসবে না। পঞ্চায়েত প্রধানের ভাতায় এত কিছু হয় না। তা ছাড়া,পদ না থাকলে কী করব! তাই কাজ ছাড়িনি। মাসে দু’হাজার টাকা আয় হয় তাতে।’’ পাশাপাশি, নিত্যদিনের নানান চাপের মাঝেও পড়াশোনার প্রতি তীব্র আগ্রহের প্রসঙ্গ উঠলেই ঝর্ণাদেবী বলেন, ‘‘এখন সবই কম্পিউটারে করতে হচ্ছে। ভাল করে পঞ্চায়েত চালাতে গেলে, পড়াশোনা দরকার। সেটা বুঝেই মাধ্যমিক দিয়ে দ্বিতীয় ডিভিশনে পাশ করেছি। এখন উচ্চমাধ্যমিকের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’
সব মিলিয়ে, ঝর্ণাদেবীর নিত্যদিনের সংগ্রাম, তার একাগ্রতায় মুগ্ধ সহকর্মী থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্যরাও। বর্ষায় ছাদ দিয়ে জল পড়লেও সরকারি অনুদানে বাড়ি তৈরীর কথা ভাবতেও পারেন না ঝর্নাদেবী। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, ‘‘বাড়ি করতে পারলে নিজেই করতে পারবেন”। শুধুমাত্র ভবিষ্যতে কখনও পদ চলে গেলেও যেন মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারেন তিনি, তার জন্যই জীবনযুদ্ধে একা লড়াই করতেও প্রস্তুত তিনি।